হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

মেরি কুরির সাধনা ও সংগ্রাম

হাসান আলী 

মেরি কুরি শুধু একজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানী নন, তিনি লড়াইয়েরও প্রতীক।

মানুষের জীবন কখনো কখনো এমনভাবে বদলে যায়, যেন সময় নিজেই পরীক্ষা নিতে চায়—তুমি সত্যিই আলো বহন করতে পার কি না। মেরি কুরির জীবন ছিল তেমনই এক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ভরা পথ। বিজ্ঞানের শিখরে দাঁড়িয়ে থাকা এই নারীকে সমাজ বারবার তিরস্কার করেছে, আঘাত করেছে, কিন্তু তিনি প্রতিবারই ভেঙে যাওয়ার বদলে আরও দৃঢ় হয়ে উঠেছেন। তাঁর জীবনের সবচেয়ে আলোচিত অধ্যায়—পল ল্যাঞ্জেভাঁর সঙ্গে সম্পর্ক। এই সত্যটিকেই সবচেয়ে উজ্জ্বল করে তোলে।

মেরির জীবনে পিয়ের কুরি শুধু স্বামী ছিলেন না; তিনি ছিলেন তাঁর গবেষণার সঙ্গী, আত্মার বন্ধু, স্বপ্নের সহযোদ্ধা। সেই মানুষটিকে দুর্ঘটনায় হারিয়ে মেরি যেন জীবনের কেন্দ্রটাই হারালেন। দুই শিশুকে নিয়ে অবসন্ন দিনগুলো, আর গবেষণাগারের নীরবতায় ডুবে থাকা রাতগুলো—সব মিলিয়ে তিনি তখন এক গভীর শূন্যতার মধ্যে ভাসছিলেন।

এই সময়ে পাশে এসে দাঁড়ালেন পল ল্যাঞ্জেভাঁ—প্রখর মেধার বিজ্ঞানী, কিন্তু নিজের দাম্পত্যে দীর্ঘদিন ধরে অসুখী এক মানুষ। দুজনের কথোপকথনে জন্ম নিল নতুন বোঝাপড়া, গবেষণার আলোচনায় মিলল মানসিক পরশ, আর চিঠির আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে তাঁরা একে অন্যের কাছে পেলেন স্বস্তির আশ্রয়। এটি ছিল মানবিক সম্পর্ক—দুজন আহত আত্মার পরস্পরের প্রতি টান, যা বিজ্ঞানচর্চার আলোয় তৈরি হয়েছিল।

কিন্তু সমাজ কখনো মানুষের মানবিক সত্য দেখতে চায় না; সে খোঁজে কেলেঙ্কারি, শোরগোল, আঙুল তোলা। ল্যাঞ্জেভাঁর স্ত্রী যখন তাঁদের ব্যক্তিগত চিঠি সংবাদমাধ্যমে দেয়, তখন মেরি কুরির গায়ে যেন শত অপমানের কাঁটা ছুটে আসে। সংবাদপত্রগুলো তাঁকে আক্রমণ করতে শুরু করে—কেউ বলে ‘বিদেশি’, কেউ বলে ‘পরিবারভঙ্গকারিণী’, কেউ আঘাত করে তাঁর নারীসত্তাকে, যেন তাঁর মেধা, ত্যাগ আর অবদান সবই অচল হয়ে গেল এই এক হামলায়।

বিস্ময়ের বিষয়—ঠিক এই সময়েই তিনি দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন। অথচ তাঁকে বলা হলো—‘আপনি যাবেন না; বিতর্ক থামা পর্যন্ত লুকিয়ে থাকুন।’ সমাজ চাইছিল তাঁর অর্জনকে এই অপমানের মধ্যেই চাপা দিয়ে দিতে। কিন্তু মেরি কুরি ছিলেন আগুনের মতো। তাঁকে দমিয়ে রাখা যায় না। তিনি বললেন, ‘আমাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে আমার গবেষণার জন্য। ব্যক্তিগত জীবন তার মাপকাঠি নয়।’

এই কথার মধ্যে ছিল শতাব্দীর সাহস, নারীর স্বাধীনতার ঘোষণা। তিনি গেলেন, পুরস্কার নিলেন, মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেন। তাঁর সেই দৃঢ়তা আজও পৃথিবীর লক্ষ মানুষের কাছে পথ দেখায়—মর্যাদা নিজের হাতে রাখতে হয়, সমাজ দিয়ে দেয় না।

ল্যাঞ্জেভাঁর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক পরবর্তী সময়ে আলাদা পথে চলে গেলেও, তাঁদের মধ্যে ছিল পারস্পরিক সম্মান। কলঙ্ক ছিল না তাঁদের সম্পর্কের ভেতরে; কলঙ্ক ছিল সেই সমাজের দৃষ্টিতে, যা একজন নারীর সাফল্যকে সহ্য করতে পারে না, যা নারীর ব্যক্তিগত জীবনকে আঘাত করে তাঁকে ছোট করতে চায়।

আজ আমরা যখন মেরি কুরির জীবন ফিরে দেখি, বুঝতে পারি—তিনি শুধু একজন প্রতিভাবান বিজ্ঞানী নন; তিনি লড়াইয়েরও প্রতীক। অবমাননা, কেলেঙ্কারি, সামাজিক আঘাত—সবকিছুর ওপরে মানুষের মেধা, শ্রম, সাহস এবং সততার জয় যে সম্ভব—মেরি কুরি সেটিই অগ্নিময় বাস্তবতায় দেখিয়েছেন। তাঁর গল্প আমাদের শেখায়—যে নারী নিজের আলো নিজের ভেতর বহন করে, তাকে কোনো অপমানই নিভিয়ে দিতে পারে না।

হাসান আলী, প্রবীণ বিষয়ে লেখক ও সংগঠক

বুদ্ধিজীবী দিবস যেন ভুলে না যাই

উড়োজাহাজগুলোও পরিবেশের ক্ষতি করছে

যে প্রশ্নগুলোর জবাব পেতে হবে

পুতিনের ভারত সফর: আঞ্চলিক ও বিশ্বরাজনীতিতে কী বার্তা দেয়

বিজয়ের মাসে শঙ্কার কথা বলি

পথকুকুর-বিড়াল হত্যা: আইন এবং শাস্তি

জীবনের অপরিহার্য অংশ সংগীত ও শরীরচর্চা

দুর্নীতি রোগে আক্রান্ত আফ্রিকা

মার্কিন নিরাপত্তা কৌশল কি আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের ব্লুপ্রিন্ট

ইমরান খান প্রতিরোধের প্রতীক