হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

বিচারবুদ্ধি যখন পাটিগণিতে পর্যবসিত

বিধান রিবেরু

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তিমে জাপানের আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের ৮০তম বার্ষিকীতে সম্প্রতি বেইজিংয়ে হয়ে গেল চীনের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সামরিক কুচকাওয়াজ। চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের আমন্ত্রণে সেই কুচকাওয়াজ দেখতে উপস্থিত ছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন। তিয়েনআনমেন স্কয়ারে মার্কিন-ব্লকবিরোধী এই তিন নেতার উপস্থিতিতে যেসব অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র প্রদর্শিত হলো, সেসব নিয়ে এখন তুমুল চর্চা হচ্ছে। তিন ক্ষমতাধর নেতার উপস্থিতিতে এমনভাবে বিজয় উদ্‌যাপন দেখে নিশ্চুপ থাকতে পারেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি বলেই বসেছেন, এই তিনজন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন।

বিশ্ব এখন এমন এক ত্রিশঙ্কু অবস্থার ভেতর রয়েছে, যা দেখলে মনে হবে কোনো শ্বাসরুদ্ধকর থ্রিলার সিনেমা দেখছি আমরা। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র বাড়তি শুল্ক চাপিয়ে দিয়ে খেপিয়ে দিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন নেতাকে, অপর দিকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যেন কিছুটা ঝুঁকে পড়েছে রাশিয়ার দিকে, কিন্তু ফিলিস্তিন প্রশ্নে তারা এখনো ইসরায়েলপন্থী। ওদিকে তাইওয়ান প্রশ্নে চীনকে সতর্ক থাকতে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতও তার চিন্তার কারণ। শুল্কের কারণে কিছুটা নারাজ হয়ে ভারত আবার চীনের সঙ্গে সখ্য দেখিয়ে মেরুকরণের বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্রকে। আর এসব ডামাডোলের ভেতর বাংলাদেশের কথা আলাদা করে আর কী বলব?

পুরো বিশ্বেই আমরা দেখতে পাচ্ছি একধরনের অসহিষ্ণুতা, আগ্রাসী মনোভাব ও চরম পদক্ষেপ নেওয়ার মানসিকতায় আক্রান্ত। সবাই যেন দুনিয়ার সবকিছুকে পাটিগণিতে নামিয়ে আনতে চায়। ঐকিক নিয়মে শুধু ‘চাওয়া-পাওয়া’র হিসাব। অন্যকে ঠকিয়ে, ঠেঙিয়ে, ছলে বলে কৌশলে নিজের ভাঁড় ভরে তোলার চরম স্বার্থপরতা। অন্যে মরলে মরুক, তাতে আমার কী—এই হলো সবার মনোভাব। কিন্তু অন্যে মরলে যে নিজের মরণটাও কাঁধে এসে নিঃশ্বাস ফেলবে সেই হুঁশ নেই। এই কারণেই আজ গোটা দুনিয়ায় অশান্তি বিরাজ করছে।

কুচকাওয়াজ উদ্বোধন করতে গিয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট সি তো বলেই দিয়েছেন, বিশ্ব এখন যুদ্ধ না শান্তি—এই দুটির একটি বেছে নেওয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। মানে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন আরকি! যে ধরনের আন্তর্মহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র, পরমাণু বহনক্ষম সাগরতলের ড্রোন, রশ্মিনির্ভর বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র দেখা গেল এই কুচকাওয়াজে, তা দেখে পশ্চিমা সামরিক বিশেষজ্ঞরা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। এর কারণ, নিজেদের সক্ষমতা প্রদর্শন ও শত্রুকে চোখ রাঙানোর পাশাপাশি কুচকাওয়াজের মাধ্যমে চীন আসলে এসব অত্যাধুনিক অস্ত্র বিক্রির সম্ভাব্য বাজারও খুঁজছে। চীনের এসব অস্ত্র যেসব দেশ কিনবে, সেখানে বাজার হারাবে অন্য অস্ত্র উৎপাদনকারী দেশগুলো। কি উপহাস!

মানুষের এমন আত্মঘাতী প্রবণতা দেখেই ম্যাক্স হর্কহাইমার ও থিয়োডর অ্যাডর্নো ‘ডায়ালেকটিক অব এনলাইটেনমেন্ট’ বইতে বলেছিলেন, জ্ঞানবিজ্ঞানের যে অগ্রগতি মানুষকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় মানবকল্যাণের জন্য, সেই একই অগ্রগতি দিয়েই আমরা আবার মানবজাতিকে ধ্বংসের প্রস্তুতি নিই। অর্থাৎ আমাদের বিচারশক্তি যেন লোপ পেয়ে যায়, আমরা স্ববিরোধী কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ি। হর্কহাইমার ও অ্যাডর্নো আমাদের বলেন, মানুষের বিচারবুদ্ধি লোপ পায় তখনই—আধিপত্য বিস্তার, যুদ্ধ বা সংঘাতের ক্ষেত্রে—যখন কেউ ফ্যাসিস্ট বা স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। যুদ্ধংদেহী ও আগ্রাসী বিশ্বনেতারা এখন নিজেরাই নিজেদের ফ্যাসিবাদী অথবা স্বৈরাচারী হিসেবেই অভিহিত করছেন।

খেয়াল করলেই দেখা যাবে, এসব বিশ্বনেতা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পাশাপাশি, যুক্তি ও বিবেককে পাশ কাটিয়ে নিজেদের স্বেচ্ছাচারিতাকেই বেশি অগ্রাধিকার দেন। এবং সেটাকে তাঁরা পুরোপুরি যুক্তিসিদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য সমমনাদের নিয়ে গড়ে তোলেন আলাদা বর্গ। এই সত্য সবার জন্যই সত্য। মানবজাতির ভেতর যে স্ববিরোধ বিরাজ করে, সেটি যেন দানব আকারে, প্রকট হয়ে আবির্ভূত হয় প্রভাবশালী বিশ্বনেতাদের মাঝে। ক্ষমতা মানুষকে একচোখা সাইক্লপসে পরিণত করে। এই একচোখা দানবেরা চায় তাদের মতো সবাই যেন একচোখেই বিশ্বকে বিচার করে। এক চোখ দিয়ে দেখা মানে তাদের আরেক চোখ অন্ধ। অন্ধত্ব ফ্যাসিবাদের জন্য সহায়ক হয়ে ওঠে।

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের সঙ্গে ধর্মান্ধতার নিকট সম্পর্ক, যথা ইস্রায়েল, নাৎসি জার্মানি। পুরুষপ্রধান ধর্মান্ধতা ধরলে ইরান, আফগানিস্তান। আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গপ্রধান উগ্রতায় আছে খ্রিষ্টান ধর্মান্ধতা। তবে ধর্মান্ধতা ফ্যাসিবাদের অবশ্যপ্রয়োজন নয়। ধরুন মুসোলিনির ইতালি, অথবা বোলসেনারোর ব্রাজিল।’

২০২৩ সালে দেওয়া এই সাক্ষাৎকারে স্পিভাক একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। সেটি হলো ধর্মান্ধতা ফ্যাসিবাদের জন্য আবশ্যিক নয়, কিন্তু ফ্যাসিবাদের সঙ্গে এর সম্পর্ক নিবিড়। বলা যেতে পারে এরা নিকট আত্মীয়। বিশ্বনেতাদের ফ্যাসিবাদী চরিত্র থেকে স্পিভাকের সাক্ষাৎকারে প্রবেশ করার কারণ, দুনিয়া থেকে এবার একটু দেশের দিকে নজর দিতে চাই। বাংলাদেশে চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানের পর সবাই বলছেন ফ্যাসিস্ট সরকার বিদায় নিয়েছে। কিন্তু এরপর যে পরিস্থিতি আমরা দেখতে পাচ্ছি, তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, ফ্যাসিবাদের আমলে ধর্মান্ধতা ছিল, এখন যেন সেটি আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তো বাংলাদেশের মানুষ ফ্যাসিবাদকে বিদায় করে তারই নিকট আত্মীয় ধর্মান্ধতাকে পেয়েছে। আর যেহেতু সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ, তাই হলফ করে বলা যায় না যে, এটি আবারও ফ্যাসিবাদকে ডেকে এনে বাড়িতে তুলবে না। হয়তো ফ্যাসিস্টের চেহারাটাই শুধু পাল্টাবে। বাকি সব একই থাকবে। ক্ষমতার অপব্যবহার, লুটপাট, দমনপীড়ন, ভিন্নমতকে জোরপূর্বক ট্যাগ দিয়ে বা নির্দিষ্ট রং চড়িয়ে তাকে কোণঠাসা করা বা নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া সবই চলবে। যা হয়েছে ফ্যাসিস্ট আমলে, সেটাই চলমান আছে এই ধর্মান্ধতার আমলে। তাহলে এই অভ্যুত্থান থেকে সাধারণ জনগণ কী পেল?

পরিতাপের বিষয়, ফ্যাসিস্ট বলি বা ধর্মান্ধ গোষ্ঠী বলি, প্রত্যেকের গন্তব্য হলো ক্ষমতা। কেউ নিজেরা ক্ষমতায় যেতে চায়, কেউবা বহিঃশক্তির সহায়তা নিয়ে সিংহাসন দখল করতে চায়। কিন্তু কেউ দেশের মৌলিক বিষয় নিয়ে কথা বলে না। ভোটাভুটি কেমন করে হবে, কোন সময়ে হবে, কে কতবার ক্ষমতায় আসীন হতে পারবে, ক্ষমতার সীমা কোন জায়গায় টানা হবে, ভারত নাকি পাকিস্তান ভালো বন্ধু হবে ইত্যাদি আলোচনা যত জোরেশোরে শোনা যায়, ততটা কিন্তু শোনা যায় না—আমরা দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কখন কমাব, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা কতটা বৃদ্ধি করব, বয়স্ক ও নারীবান্ধব একটি রাষ্ট্র বিনির্মাণ করব, শিক্ষাকে আধুনিকায়ন করব, কৃষি খাতকে ঢেলে সাজাব, কৃষকের দুঃখ-দুর্দশা দূর করব ইত্যাদি। আমি বলছি না ক্ষমতার হালুয়া-রুটি ভাগাভাগির আলাপ কম গুরুত্বপূর্ণ, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। তবে ভবিষ্যতে আমাদের যারা শাসন করবে, তারা যদি শোষণ কীভাবে চালানো যায়, সেই আলাপটাই বেশি বেশি করে, তাহলে সেটি দৃষ্টিকটু লাগে। এবং সবচেয়ে মজার বিষয় জনগণ নিজেরাই ক্ষমতার ভাগাভাগি প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত এবং তারা অন্ধের মতো শাসকদের বয়ান ক্রয় করছে এবং তোতাপাখির মতো বিলিয়ে চলেছে। কিন্তু পাখির নিজের যে বন্দিদশা, তার দানাপানির যে করুণ অবস্থা, সেদিকে খেয়াল নেই।

গোটা পৃথিবীতেই এখন এই সংকট দৃশ্যমান। মানুষ বিশ্বনেতাদের বয়ানকে নিজের মত হিসেবে গ্রহণ করছে। তারা বিভিন্ন শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। তারা একবারও বলছে না, হে বিশ্বনেতৃবৃন্দ সামরিক কুচকাওয়াজে মারণাস্ত্র প্রদর্শনের বদলে এমন প্রযুক্তি দেখাও, যা দিয়ে বসুন্ধরাকে আরও সবুজ করা যায়, মানুষের তৈরি কলকারখানাকে আরও প্রকৃতিবান্ধব করা যায়, কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ কমানো যায়। কেমন করে ভাষা, সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক সীমারেখার প্রতিবন্ধকতাকে দূর করে জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চাকে সহভাগিতার মধ্যে আনা যায়। বহুজনের জ্ঞান (ইন্ডিজেনাস নলেজ) তথা আদি সভ্যতার জ্ঞানকে পুনরুদ্ধার করে কীভাবে তা আধুনিক চর্চার ভেতর প্রাসঙ্গিক করে তোলা যায়। কীভাবে সাংস্কৃতিক চর্চা বৃদ্ধি ও বিনিময়ের ভেতর দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে একে অপরকে জানা ও বোঝার সুযোগ করে দেওয়া যায়। সত্য হলো, সত্য কাজে কেউ নয় রাজি, সবই দেখি স্বার্থ আর দ্বন্দ্বের খেলা।

পরিশেষে তাই বলতে চাই, শুধু বাঙালি নয়, গোটা মানবজাতিই আসলে আত্মঘাতী। এই আলাপই হর্কহাইমার আর অ্যাডর্নো করেছেন। আমরাও করে চলেছি। কিন্তু তাতে তেমন একটা লাভ যে হচ্ছে না, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। আগামী কয়েক শ বছরেও হবে কি না, কে জানে? তারপরও ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, স্বৈরাচার, অবিচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর উচ্চকিত রাখতে হবে। এবং কাউকেই সমালোচনার ঊর্ধ্বে রাখা চলবে না।

যেখানে মুক্তিযুদ্ধ বেঁচে থাকে

মা কুকুর ও তার আটটি ছানা

যেথায় হাওয়ায় ভাসে ফুলের কান্না

মিসরের আরেকটি নামকাওয়াস্তে ভোট

ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কি থাকছে

চীন-আমিরাত সামরিক সখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভেতর-বাহির

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শিক্ষা কেন দরকার

ক্যারিয়ার নিয়ে বিভ্রান্তি

বিষ্ণু দের কাব্যচেতনার সমগ্রতা