হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

তথ্যযুদ্ধের যুগে সত্যের সংকট

ড. জাহাঙ্গীর আলম সরকার

এই পৃথিবী এখন এমন এক অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে গোলাগুলি নেই, যুদ্ধবিমান নেই, কিন্তু আছে ‘ডিজিটাল আগ্রাসন’, ‘সাইবার বিভ্রান্তি’, ‘অ্যালগরিদমিক নিয়ন্ত্রণ’ এবং ‘ডেটা-হাইজ্যাকিংয়ের’ মতো নিঃশব্দ অস্ত্র। একসময় রাষ্ট্রের ক্ষমতা নির্ধারিত হতো ভূখণ্ড, সেনা ও অস্ত্র দ্বারা; আজ ক্ষমতা নির্ধারিত হচ্ছে তথ্যের নিয়ন্ত্রণ এবং সত্যের মালিকানা দ্বারা। আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সংকট এখন আর সামরিক সংঘাত নয়—বরং সত্যের পতন এবং মানবমনে ধারাবাহিকভাবে পরিচালিত এক বৈশ্বিক তথ্যযুদ্ধ।

জাতিসংঘের ২০২৪ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে—পৃথিবীতে প্রতিদিন তৈরি হওয়া তথ্যের পরিমাণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মানুষ এখন আর তথ্যের ভেতরে নয়, তথ্য-উৎপন্ন বিভ্রমের ভেতরে বাস করছে। প্রতি সেকেন্ডে লাখ লাখ পোস্ট, ভিডিও, অডিও, ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সেই বিপুল তথ্যের ভিড়ে সত্য সবচেয়ে দুর্লভ, সবচেয়ে ভঙ্গুর বস্তু হয়ে উঠেছে। ফেসবুক-টুইটার (এক্স) ইউটিউব-টিকটক—এই চার প্ল্যাটফর্মেই বিশ্ব জনমতের অর্ধেকের বেশি নিয়ন্ত্রিত। অ্যালগরিদম এমনভাবে নির্মিত যে যেটা দ্রুত ছড়ায়, সেটাই ‘জনমত’। অথচ দ্রুত ছড়ায় সাধারণত উত্তেজনামূলক, অসম্পূর্ণ এবং ভুয়া তথ্যই। ফলে মানুষ তথ্যসমৃদ্ধ হলেও সত্য-অনাবৃত।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডিসইনফোল্যাব দেখিয়েছে—রাশিয়া, চীন, ইরান, এমনকি পশ্চিমা শক্তিগুলোর মধ্যেও চলছে সমান্তরাল তথ্যযুদ্ধ। একটি ভুয়া ভিডিও বা একটি ফটোশপ করা ছবি এখন একটি নির্বাচনের ফল পর্যন্ত প্রভাবিত করতে পারে কিংবা একটি দেশের মুদ্রাবাজার কাঁপিয়ে দিতে পারে কিংবা জাতিগত সংঘাত উসকে দিতে পারে কিংবা আন্তর্জাতিক কূটনীতি উত্তপ্ত করতে পারে। ২০২০ সালে মার্কিন নির্বাচন, ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ, মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থান, ভারতের কয়েকটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা—এসবের পেছনে ভুয়া তথ্যকে কেন্দ্র করে সংগঠিত ডিজিটাল প্রচারণার নির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা এটিকে বলছেন ‘কম খরচের, উচ্চ প্রভাবশালী ভূ-রাজনৈতিক অস্ত্র’।

এআইনির্ভর ডিপফেক এখন পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য-অস্ত্র। একটি মুখ, একটি কণ্ঠ, একটি বক্তব্য কয়েক সেকেন্ডে বাস্তবসম্মত করে তোলা যায়। এমন ভিডিও ইতিমধ্যে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে দিয়ে আত্মসমর্পণের ভুয়া ঘোষণা অথবা পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের অপমানিত করার প্রচারণা অথবা ভারতের কয়েকজন নারী রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে ডিপফেক দিয়ে কেলেঙ্কারি ছড়ানো অথবা যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কণ্ঠ নকল করে ভোটারদের বিভ্রান্ত করা। এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করছে: ডিপফেক সত্যকে শুধু প্রশ্নবিদ্ধ করছে না, সত্যের অস্তিত্বকেই অস্থির করে দিচ্ছে। বিশ্বের তিনটি গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ, এমআই-৬, মোসাদ) সম্প্রতি জানিয়েছে, ভবিষ্যতের গুপ্ত অপারেশনগুলো আর বন্দুক দিয়ে নয়, বরং ডিপফেক এবং এআই প্রচারণা দিয়েই চালানো হবে।

তথ্যযুদ্ধের উদ্দেশ্য শুধু মানুষকে বিভ্রান্ত করা নয়; এর বৃহৎ উদ্দেশ্য হলো, মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে দাঁড় করানো। ধর্ম, জাতি, ভাষা, রাজনৈতিক মতাদর্শ—এই পরিচয়গুলোকে ব্যবহার করে বিভাজনকে গভীর করা হচ্ছে। কয়েকটি দেশভিত্তিক উদাহরণ—২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কায় ভুয়া ফেসবুক পোস্ট থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা; ২০২১ সালে ইথিওপিয়ায় টিকটকের ভিডিও দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়ায়; ২০২০-২১ সালে ব্রাজিলে ভুয়া তথ্য গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে; ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত: ভুল ছবি ও ভিডিও দিয়ে বিশ্বজনমত বিভক্ত করা হয়।

একটি গণতন্ত্র টিকে থাকে সচেতন নাগরিক, মুক্ত গণমাধ্যম এবং তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্তের ওপর। কিন্তু যদি নাগরিকের তথ্যই ভুয়া হয়, তার সামনে সাজানো বাস্তবতা তুলে ধরা হয়, প্রযুক্তি তার চিন্তাভাবনাকে অজান্তে নিয়ন্ত্রণ করে, তাহলে নির্বাচন, নীতি, বিচার—সবকিছুই হয়ে ওঠে কৃত্রিম ও নিয়ন্ত্রিত। অধিকাংশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন পরবর্তী বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ ভূখণ্ডের জন্য নয়, বরং মানবমনের জন্য। এই লড়াই চলছে এখন নীরব, নিঃশব্দ, কিন্তু ভয়াবহ শক্তিতে।

ব্রিটেনের রয়্যাল সোসাইটি এবং ইউনেসকো উভয়ই স্বীকার করেছে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সত্য-যুদ্ধ লড়ছে সাংবাদিকতা। কারণ, ভুয়া খবরের গতি, নাটকীয়তা, শেয়ারযোগ্যতা এবং অ্যালগরিদমিক পৌঁছানো বেশি। ফলে প্রথাগত সাংবাদিকতা সত্য উৎপাদনে যতই সতর্ক থাকুক, মিথ্যা সংবাদ অনেক সময়ই গ্রহণযোগ্যতার দৌড়ে জিতে যায়। সাংবাদিকতা শুধু আর্থিক নয়, নৈতিক সংকটেও নিমজ্জিত হয়েছে।

তথ্যযুদ্ধ এখন পৃথিবীর সবার যুদ্ধ। তাই এর মোকাবিলা করতে হলে আন্তর্জাতিক পরিসরেই তৈরি করতে হবে সত্যের সুরক্ষা-ব্যবস্থা। এ লড়াই শুরু হয় ডিজিটাল সাক্ষরতা থেকে—স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় এবং কর্মক্ষেত্রে মানুষকে শেখাতে হবে কোন তথ্য বিশ্বাসযোগ্য, কোনটি নয়। এই সচেতনতা ছাড়া সমাজ সহজেই ভুয়া খবরের বন্যায় ভেসে যায়। পাশাপাশি, এআই নিয়ন্ত্রণে বৈশ্বিক ঐক্য এখন সময়ের দাবি। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জি২০—সব প্ল্যাটফর্মেই ডিপফেক ও অ্যালগরিদমিক প্রভাবের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নীতিমালা তৈরির আলোচনা চলছে। কারণ, এক দেশের তৈরি বিভ্রান্তি কয়েক মিনিটেই অন্য দেশের রাজনীতিকে নাড়িয়ে দিতে পারে।

এই লড়াইয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হলো অ্যালগরিদমিক স্বচ্ছতা। মানুষ কী দেখে এবং কেন দেখে তার জবাব প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিতে হবে। অ্যালগরিদমের আড়ালে তথ্য নিয়ন্ত্রণের খেলা চলতে থাকলে সত্য নিজেই বন্দী হয়ে পড়ে। আর এইসব প্রচেষ্টার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা। নিরাপদ ও স্বাধীন সাংবাদিকতা ছাড়া সত্যের পক্ষে কোনো বৈশ্বিক কূটনীতি সম্ভব নয়। কারণ, তারাই প্রথমে মিথ্যা উন্মোচন করে, আর সত্যকে সামনে নিয়ে আসে। অতএব শিক্ষা, প্রযুক্তি, নীতি ও মুক্ত সাংবাদিকতার সমন্বিত উদ্যোগেই গড়ে উঠতে পারে এমন এক বিশ্ব, যেখানে সত্য প্রতিরক্ষিত হবে এবং বিভ্রান্তির অন্ধকার ভেদ করে উঠবে আলোর কূটনীতি।

গণমাধ্যমকে শক্তিশালী না করলে ভুয়া তথ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জেতা যাবে না। মানুষ একসময় সত্যকে আলো বলত। আজ সেই আলো ম্লান—ডিজিটাল ধুলায় আকাশ আঁধারের মতো। তথ্যযুদ্ধ এখন আর শুধু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়, এটি মানুষের মন, তার বিবেক, তার যুক্তি, তার মানবিকতার বিরুদ্ধে এক অদৃশ্য যুদ্ধ। তবু আশার জায়গা আছে। ইতিহাস বলে—সত্যকে পিছিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু পরাজিত করা যায় না।

ড. জাহাঙ্গীর আলম সরকার, আইনজীবী ও গবেষক

বুদ্ধিজীবী দিবস যেন ভুলে না যাই

উড়োজাহাজগুলোও পরিবেশের ক্ষতি করছে

যে প্রশ্নগুলোর জবাব পেতে হবে

পুতিনের ভারত সফর: আঞ্চলিক ও বিশ্বরাজনীতিতে কী বার্তা দেয়

বিজয়ের মাসে শঙ্কার কথা বলি

পথকুকুর-বিড়াল হত্যা: আইন এবং শাস্তি

জীবনের অপরিহার্য অংশ সংগীত ও শরীরচর্চা

দুর্নীতি রোগে আক্রান্ত আফ্রিকা

মার্কিন নিরাপত্তা কৌশল কি আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের ব্লুপ্রিন্ট

ইমরান খান প্রতিরোধের প্রতীক