হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

বস্তি: এক শহরে দুই বাস্তবতা

নুসরাত জাহান

প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা যেন একটি বেনারসি শাড়ির আঁচল, যার এক প্রান্তে সোনালি জরির কাজ আর অন্য প্রান্তে গলিত সুতোয় দাগ পড়া দারিদ্র্যের ছাপ। একই চাদরে ঢাকা দুটি পৃথিবী, যার একটি অস্তিত্বের লড়াইয়ে ব্যস্ত এবং অন্যটি বিলাসিতায় গা ভাসানোর মতো। একদিকে বৈভবের বহিঃপ্রকাশ, অন্যদিকে প্রয়োজনের হাহাকার।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা স্বাধীনতার অর্ধশতক পরেও যেন শুধু একটি শহর নয়, একটি অদৃশ্য শ্রেণিবৈষম্যের চিত্রপট। এই শহরের এক কোণে যেমন দামি অ্যাপার্টমেন্ট, চকচকে গাড়ি, বিলাসবহুল ব্যবহার্য জিনিসপত্র নিয়ে গড়ে ওঠা ধনীদের রাজত্ব, অন্য কোণে স্যাঁতসেঁতে ঘর, কাদামাখা রাস্তা, টিনের চালার নিচে গড়ে ওঠা দরিদ্রদের জীবনসংগ্রাম। এখানে যেমন রয়েছে গুলশান-বনানীর ঝলমলে আলো, তেমনই রয়েছে মিরপুর, কড়াইল ও রায়েরবাজারের বস্তির অন্ধকার দিক। এই দ্বৈত রূপই যেন ঢাকাকে বিভক্ত করে ফেলেছে দুই ভাগে—বস্তি আর বিলাসবহুলতায়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ঢাকায় প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ বস্তিতে বাস করে। ২০২২ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার বস্তিবাসীদের অধিকাংশই দৈনিক আয় করেন ২০০-৩০০ টাকা। তারা পায় না নিরাপদ পানি, স্যানিটেশন, স্বাস্থ্যসেবা বা শিক্ষার ন্যূনতম সুবিধা। অপরদিকে বিলাসবহুল এলাকায় একজন মানুষের দৈনিক ব্যয়ের পরিমাণ হয়তো এক রাতের ডিনারে পাঁচ হাজার টাকার বেশি। এই ফারাক শুধু সংখ্যায় নয়, এটি এক নির্মম বাস্তবতা।

রাজধানীর অদৃশ্য বৈষম্যের কারণ কী?

বাংলাদেশের রাজধানীর অদৃশ্য বৈষম্যের অন্যতম কারণ শহরের উন্নয়ন পরিকল্পনায় বারবার উপেক্ষিত হওয়া দরিদ্র জনগোষ্ঠী। জীবন নির্বাহের জন্য পুরো উপার্জনের টাকা চলে যায় পেট ভরতে, আর মাথা গোঁজার ভাড়া দিতে। তাই বাধ্য হয়ে অল্প টাকায় থাকার জন্য ঠাঁই নিতে হচ্ছে বস্তিতে। আবার বস্তিতে বাস করেও জীবনের নিরাপত্তা থাকে না। প্রতিবছর বিভিন্ন কারণে বস্তিতে আগুন লেগে যায়। এই আগুন লাগার অন্যতম কারণ প্রভাবশালীদের দ্বারা অবৈধভাবে বস্তির জমি দখলের চেষ্টা। সীমিত সুযোগ-সুবিধা, নিম্ন শিক্ষার হার ও কর্মসংস্থানের অভাবে দরিদ্ররা শহরের কেন্দ্রে অবস্থান করেও থেকে যায় উন্নয়নের বাইরে, যা অর্থনৈতিক বৈষম্যের মূল কারণ।

ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের অবসান কোথায়?

ধনী-গরিবের বৈষম্যের অবসান করতে হলে ঢাকার উন্নয়ন হতে হবে সমতা ও অন্তর্ভুক্তির ভিত্তিতে। বস্তির উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ না করে পুনর্বাসনের প্রকল্প গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকার যদি বস্তিবাসীদের জন্য নিরাপদ, স্বাস্থ্যকর আবাসনের ব্যবস্থা করে, তবে তারা উন্নয়নের আওতাভুক্ত হতে পারবে। বস্তিবাসীদের দক্ষতা উন্নয়নের জন্য কারিগরি শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। নগর ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে হবে। সমাজের উচ্চ শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে এবং নিম্ন শ্রেণিকে উন্নয়নের আওতায় আনতে জনসচেতনতা ও সহানুভূতি সৃষ্টি করতে হবে।

ঢাকা শহরের এই বিভক্ত চিত্র শুধু গঠনগত বৈষম্য নয়, একটি মনোভাবগত সংকটও। ‘নিজে ভালো আছি’ বলে অন্যের দিকে অবহেলার দৃষ্টি দেওয়ার মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। দরিদ্র মানুষ সমাজের বোঝা নয়, তারা সমাজের অবহেলিত শ্রেণি। বস্তিতে বসবাস করা প্রতিটি ব্যক্তি লড়াই করে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য। শহরের সৌন্দর্য তখনই পরিপূর্ণ হবে, যখন গুলশান-বনানীর শিশিরভেজা ভোর একদিন কড়াইল বস্তির শিশুটির চোখেও এক নতুন সম্ভাবনার আলো হয়ে ধরা দেবে।

আমাদের রাজধানীকে সবার জন্য বসবাসযোগ্য করে তুলতে হবে। অন্যথায় এই বিভক্ত ঢাকা আমাদের ফিরিয়ে দেবে বিভাজন, বিষণ্নতা আর বঞ্চনা।

যেখানে মুক্তিযুদ্ধ বেঁচে থাকে

মা কুকুর ও তার আটটি ছানা

যেথায় হাওয়ায় ভাসে ফুলের কান্না

মিসরের আরেকটি নামকাওয়াস্তে ভোট

ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কি থাকছে

চীন-আমিরাত সামরিক সখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভেতর-বাহির

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শিক্ষা কেন দরকার

ক্যারিয়ার নিয়ে বিভ্রান্তি

বিষ্ণু দের কাব্যচেতনার সমগ্রতা