শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চলমান একটি মামলায় রায়ের তারিখ ঘোষণা ঘিরে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ১৩ নভেম্বর ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচির ডাক দিয়েছিল। বিদেশে অবস্থানরত এক নেতা ভার্চুয়াল মাধ্যমে ওই কর্মসূচি ঘোষণা করলেও আগের দিন থেকে কোথাও কোথাও কিছু যানবাহনে আগুন দেওয়া আর ককটেলের বিস্ফোরণ ছাড়া রাজধানীতে আর কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি। কর্মসূচি নিয়ে বিভিন্ন দলের বিভিন্ন ধরনের বক্তব্যে জনমনে শঙ্কা তৈরি হয়। যে কারণে আগের রাত থেকে রাজধানীর সড়কে যানবাহন কমে যায়। গণপরিবহন চলেছে তুলনামূলক কম। ১৩ নভেম্বর এর সংখ্যা ছিল আরও কম। রাস্তায় যাঁরা বেরিয়েছেন, তাঁদের কোনো সিগন্যালেই থেমে থাকতে হয়নি।
‘লকডাউন’ কর্মসূচিতে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের কর্মী সন্দেহে এক নারীকে পিটিয়েছেন এনসিপির এক নারী কর্মী। লাঞ্ছিত নারীকে জুলাই হত্যার একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ। একই রকম সন্দেহে এক রিকশাচালককেও মারধর করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাড়াবাড়ির প্রকাশ ঘটে নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে আটক করার ঘটনায়। গাজীপুর থেকে আসা ওই শিক্ষার্থীর অপরাধ—তার ব্যাগে ছিল মুক্তিযুদ্ধের বই এবং ধানমন্ডি ৩২ নম্বর থেকে সংগ্রহ করা একটি ইট। ব্যাপক সমালোচনার মুখে অবশ্য ওই কিশোরকে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে ১৩ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জানিয়েছেন, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে অনুষ্ঠিত হবে গণভোট। চারটি প্রস্তাবের ওপর একটি প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ ভোট দিতে হবে ভোটারদের। একই দিনে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশও জারি করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি এই আদেশ জারি করলেন। জুলাই সনদের আলোকে গণভোটের ব্যালটে উপস্থাপন করা প্রশ্নও নির্ধারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে প্রস্তাবগুলোর উল্লেখ ছিল। একটি প্রস্তাবে উল্লেখ থাকছে, আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারির ফলে মনে হতে পারে, সরকার বুঝি সাপও মারল, আবার লাঠিও ভাঙল না! কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলা বাহাস থামেনি। জাতীয় নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট অনুষ্ঠানের ঘোষণাটি বিএনপির পক্ষে গেলেও সংসদের উচ্চকক্ষসহ কিছু বিষয়ে দলটি নাখোশ। প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ শেষ হওয়ার পরপরই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছেন, তাতে জুলাই জাতীয় সনদ ‘লঙ্ঘিত’ হয়েছে। রাতে অবশ্য দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভা শেষে সংবাদ সম্মেলন করে সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়ায় প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানানো হয়েছে। বিএনপি আগে থেকে এমনটি চেয়ে আসছিল। অন্যদিকে, জামায়াত, এনসিপিসহ কিছু দল জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট আয়োজনের দাবিতে সোচ্চার। সেই প্রত্যাশা পূরণ না হলেও সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়ে তাদের দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। আবার প্রধান উপদেষ্টার স্বাক্ষরে আদেশ জারির অবাস্তব চাওয়া পূরণ হয়নি।
গণভোট আর জাতীয় নির্বাচন একসঙ্গে করার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে দ্বিমত জানিয়েছে জামায়াতসহ আটটি দল। গত বৃহস্পতিবার রাতে এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, পুরো ভাষণ বিশ্লেষণ করলে জাতির স্বস্তি ও মুক্তির প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে, এটা বলা যায় না। ওই সময় পাঁচটি দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা আটটি ইসলামি দলের নেতারা তাঁর সঙ্গে ছিলেন। বিএনপির সমালোচনা করে তাহের বলেন, জুলাই সনদে সই করার পরও বিএনপির পক্ষ থেকে সংস্কার ইস্যুতে নানামুখী কথা বলা শুরু হয়েছে। জুলাই সনদের বাস্তবায়ন আদেশ, গণভোটের কাঠামো এবং সংস্কারপ্রক্রিয়া সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার আগে এনসিপি এতে সই করবে না বলে জানিয়েছেন দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। গত শুক্রবার এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদের বাস্তবায়ন আদেশ, গণভোট এবং সংস্কারের প্রক্রিয়া নিয়ে এখনো অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিলে আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করব।’
জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশে বলা হয়েছে, ‘সংবিধান সংস্কার বিষয়ে জুলাই জাতীয় সনদে অন্তর্ভুক্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের জন্য সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী জনগণের অনুমোদন প্রয়োজন এবং এই উদ্দেশ্যে গণভোট অনুষ্ঠান, সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন ও পরিষদ কর্তৃক সংবিধান সংস্কার করার আবশ্যকতা রয়েছে।’ জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ধারাবাহিক আলোচনায় অংশ নেওয়া একজন রাজনীতিকের প্রশ্ন, ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ কোথা থেকে এল। এটা নিয়ে তো কোনো আলোচনাই হয়নি।’ এ ছাড়া এতগুলো প্রস্তাবের বিষয়ে একটিমাত্র ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দেওয়ার বিষয়ে ব্যাপক বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। মরিয়ম আক্তার নামের একজন বেসরকারি চাকরিজীবী এ প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘আমি যদি দুটি বিষয়ে “হ্যাঁ” মনে করি, আর দুটি বিষয়ে “না”, তখন আমি কী করব?’
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে মনে হতে পারে, রাজনীতির আকাশে সব মেঘ কেটে গেছে এবং যথাসময়ে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে অনেক জটিলতা এখনো রয়ে গেছে। যেসব দল প্রকাশ্যে বিএনপির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছে, আড়ালে তারাই দলটির কাছে সংসদ নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় আসন ছাড় এবং পরবর্তী সরকারের মন্ত্রিত্ব নিয়ে দর-কষাকষিতে লিপ্ত হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, দৃশ্যের আড়ালে ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে নিয়ে পরাশক্তিগুলোর টানাটানি। রাজনীতি, সংস্কার, নির্বাচন ইত্যাদি নিয়ে দলগুলোর বাহাস মূলত মেকি ও লোকদেখানো। সেই সঙ্গে মানুষকে মোহিত করারও প্রয়াস। আসল খেলা তো চলছে আড়ালে, সন্তর্পণে।
যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে আসছে তার ইন্দো-প্যাসিফিক (ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল) স্ট্র্যাটেজিতে বাংলাদেশকে টানার। ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি প্রতিরক্ষা চুক্তির রূপরেখায় সই করায় বাংলাদেশের ওপর এর প্রভাব কী হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা খুবই কম। ওই রূপরেখায় সই করার দিন (৩১ অক্টোবর) ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চুক্তির লক্ষ্য ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের নিরাপত্তা জোরদার করা।
এ ছাড়া এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য পুনর্নির্ধারণেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ওই চুক্তির পর ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় কোনোভাবে বাংলাদেশেরও জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি কি তাহলে বাড়েনি?