ইউক্রেনকে ‘শায়েস্তা’ করতে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সামরিক পদক্ষেপ নেয় রাশিয়া। সেই ‘শায়েস্তা’করণ কার্যক্রম এখনো চলছে। আর কয়েক মাস এভাবে চললে এই যুদ্ধ পঞ্চম বর্ষে গড়াবে। বলা হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউক্রেন যুদ্ধই ইউরোপের সবচেয়ে প্রাণঘাতী যুদ্ধ।
অবশ্য ক্ষমতায় আসার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই যুদ্ধ থামাতে নানা কূটনৈতিক উদ্যোগ নিয়েছেন, দিয়েছেন হুমকি-ধমকি। তবে কিছুতেই কিছু হয়নি। সবশেষে তিনি রাশিয়াকে ‘খুশি করে’ ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর পরিকল্পনা এঁটেছেন, তৈরি করেছেন ২৮ দফা প্রস্তাব। কিন্তু সেই প্রস্তাব বাস্তবায়নে হয়তো ইউক্রেন যুদ্ধ আপাতত থামবে, তবে মর্যাদাহানি হবে আক্রান্ত ইউক্রেনেরই।
বিবিসি, সিএনএনসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে ট্রাম্পের সেই ২৮ দফা প্রস্তাব সম্পর্কে আমরা এরই মধ্যে জেনে গেছি। এসব দফার কয়েকটি দফা পর্যালোচনা করলেই ইউক্রেনের মর্যাদাহানির বিষয়টি পরিষ্কার হয়। একটি দফায় বলা হয়েছে, ইউক্রেনের ক্রিমিয়া, লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। খোদ যুক্তরাষ্ট্র এই স্বীকৃতি দেবে। খেরসন ও জাপোরিঝিয়া এমন অঞ্চলে পরিণত হবে, যা মূলত রুশ নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলেই আভাস দেওয়া হয়েছে পরিকল্পনায়। যদিও এই দুই এলাকা ‘ফ্রোজেন’ অঞ্চল হবে বলে ২৮ দফায় উল্লেখ করা হয়েছে। দোনেৎস্কের যেসব অঞ্চল এখন ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে, সেসব অঞ্চল থেকে দেশটির বাহিনী প্রত্যাহারের শর্ত দেওয়া হয়েছে। ওই অঞ্চল অসামরিকায়িত অঞ্চল (ডিমিলিটারাইজড জোন) হিসেবে বিবেচিত হবে, যেখানে রুশ কিংবা ইউক্রেনীয়—কোনো বাহিনীই প্রবেশ করবে না।
আমরা জানি, এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত অসামরিকায়িত অঞ্চল হলো দুই কোরিয়ার মধ্যেকার অঞ্চল। আমরা এটাও জানি, নথিপত্র আর মুখের কথায় অসামরিকায়িত অঞ্চল বলা হলেও ওই অঞ্চলটি বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক। সেখানে প্রবেশ মানে কোনো না কোনো দেশের বাহিনীর হাতে নির্ঘাত মৃত্যু। ট্রাম্পের পরিকল্পনা যে আরেকটি অত্যন্ত বিপজ্জনক অসামরিকায়িত অঞ্চল ‘প্রসব’ করবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
একটি দফায় বলা আছে, ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হতে পারলেও কোনো দিন মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটে ঢুকতে পারবে না। ন্যাটোতে না ঢোকার শর্ত ইউক্রেনকে তার সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ইউক্রেনকে কোনো দিন সদস্য না করার শর্ত ন্যাটোকেও তার সনদে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ন্যাটো কোনো দিন ইউক্রেনে সেনা মোতায়েন করবে না বলেও শর্ত দেওয়া হয়েছে ট্রাম্পের পরিকল্পনায়। ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর আকার ৬ লাখ সদস্যের বেশি হতে পারবে না বলেও শর্ত দেওয়া হয়েছে। আরেকটি শর্তে বলা হয়েছে, জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বিদ্যুতের অর্ধেক যাবে রাশিয়ায়, বাকি অর্ধেক যাবে ইউক্রেনে।
এই ত্যাগগুলো শিকারে যদি ইউক্রেন রাজি থাকে, তাহলেই কেবল মার্কিন নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেবে। এই দফাগুলো পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়, যুদ্ধ থামাতে শুধু রক্তই পর্যাপ্ত নয়, মর্যাদাহানিও মেনে নিতে হবে ইউক্রেনকে।
আরেকটি শর্তে বলা হয়েছে, দুই পক্ষ পারস্পরিক বিরোধ নিষ্পত্তিতে রাজি হওয়ার ১০০ দিনের মধ্যে ইউক্রেনকে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। অর্থাৎ দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও হুমকিতে পড়েছে।
রাশিয়ার প্রথম লাভ—ভূখণ্ড দখলে আসা এবং তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। যে অঞ্চলগুলো রাশিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে পরিকল্পনায়, সেগুলো ভৌগোলিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার প্রভাব তখন আরও বাড়বে। শুধু তা-ই নয়, জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনেও মস্কো অর্ধেক ভাগ বসাবে। রাশিয়ার জন্য আরও অনেক ‘পুরস্কার’ আছে ট্রাম্পের পরিকল্পনায়। এগুলোর অন্যতম হলো—যুদ্ধকালে সংঘটিত যেকোনো অপরাধের দায়মুক্তি পাবে উভয় পক্ষ। ইউক্রেনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ঝুলছে। সব পক্ষ পরিকল্পনায় রাজি থাকলে পুতিনের ওপর থেকে সেই পরোয়ানা উঠে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
এ তো গেল পুতিনের ব্যক্তিগত সুবিধার কথা। দেশ হিসেবে রাশিয়াও কম লাভবান হবে না। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ইউক্রেন যুদ্ধ থামলে রাশিয়ার ওপর থেকে প্রায় সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পথ তৈরি হবে। যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি, প্রাকৃতিক সম্পদ, অবকাঠামো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডেটাসেন্টার, বিরল খনিজসহ নানা ক্ষেত্রে রাশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতায় যাবে। রাশিয়াকে শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৮-এ পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করতে আমন্ত্রণ জানানো হবে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতিতে আবারও শক্তিশালী খেলোয়াড় হয়ে ফিরবে মস্কো।
ট্রাম্পের পরিকল্পনায় অবশ্য ইউক্রেনের জন্যও কিছু সান্ত্বনা ‘পুরস্কার’ রয়েছে। যেমন ইউক্রেনে হামলা চালানোর কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের রুশ সম্পদ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অবরুদ্ধ করেছে, তা ইউক্রেন পুনর্গঠন এবং দেশটিতে বিনিয়োগে ব্যবহার করা হবে। তবে সেই বিনিয়োগ থেকে যে মুনাফা আসবে, যুক্তরাষ্ট্র তার ৫০ শতাংশ পাবে বলে শর্ত দেওয়া হয়েছে। পরিকল্পনায় ইউরোপে ইউক্রেনের মিত্র দেশগুলোর জন্য মৃদু ‘চপেটাঘাতের’ ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। সেটা হলো ইউক্রেন পুনর্গঠনে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য ইউরোপকে ১০০ বিলিয়ন ডলার তহবিলের জোগান দিতে হবে।
ইউক্রেনকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দিতে রাশিয়ার জন্য কয়েকটি ‘কঠোর’ শর্ত রয়েছে পরিকল্পনায়। এগুলোর মধ্যে অন্যতম, ইউরোপ ও ইউক্রেনে আর হামলা চালানো হবে না মর্মে রাশিয়াকে আইন প্রণয়ন করতে হবে। রাশিয়া আর কোনো দিন তার প্রতিবেশী কোনো দেশকে আক্রমণ করবে না মর্মে ‘আশাবাদও’ ব্যক্ত করা হয়েছে পরিকল্পনায়। তবে এসব ‘কঠোর’ শর্তের বিপরীতে মস্কোকে কিছুটা খুশি করারও চেষ্টা করা হয়েছে। রাশিয়া, ইউক্রেন ও ইউরোপের মধ্যে এমন একটি বিশদ চুক্তি হবে, যার আওতায় কোনো পক্ষ অপর পক্ষের ওপর আগ্রাসন চালাবে না। এই চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে ধরে নেওয়া হবে, পক্ষগুলোর মধ্যে তিন দশক ধরে চলে আসা বিবাদগুলোর অবসান ঘটেছে।
এবার আসা যাক যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কী রেখেছেন ট্রাম্প তাঁর পরিকল্পনায়, সে প্রশ্নে। মার্কিন নেতৃত্বে অবরুদ্ধ হওয়া রুশ সম্পদের একাংশ ইউক্রেনে বিনিয়োগ করা হবে এবং তার থেকে অর্জিত মুনাফার অর্ধেক যাবে যুক্তরাষ্ট্রের পকেটে। শুধু তা-ই নয়, ইউক্রেনকে যে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেবে যুক্তরাষ্ট্র, তার বিনিময়ে তাকে অর্থমূল্য দিতে হবে। মার্কিন এই নিশ্চয়তার মধ্যে ‘হুমকিও’ রয়েছে। তা হলো—ইউক্রেন যদি কোনো দিন রাশিয়ায় আক্রমণ করে, তাহলে সে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা হারাবে। আর রাশিয়া আক্রমণ করলে প্রত্যাহার করে নেওয়া সব আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা পুনরায় আরোপ করা হবে দেশটির ওপর।
তো এই হলো ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে ট্রাম্পের পরিকল্পনার আপাত দৃশ্যমান পর্যালোচনা। এটুকুতেই পরিষ্কার, এই যুদ্ধ থামাতে ইউক্রেনকে কতটা চড়া মূল্য দিতে হবে। যেখানে এই আধুনিক যুগে এসে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে বহিঃশক্তির আক্রমণ কল্পনাও করা যায় না, সেখানে ভূখণ্ড হারিয়ে অনেকটা নাকে খত দেওয়ার মতো করে যুদ্ধ থেকে পরিত্রাণ পেতে হচ্ছে ইউক্রেনকে। ইউক্রেনের মিত্ররা এই মর্যাদাহানি থেকে দেশটিকে বাঁচাতে কিছুটা দৌড়ঝাঁপ করছে, কিন্তু তাতে কতটা কী হবে, তা এখনো বলা দায়।
লেখক: সাংবাদিক