হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

ডাচ কৃষি: আধুনিক প্রযুক্তির অর্গানিক খামার

শাইখ সিরাজ

ফোন্স আইকোলকাম্প ও ড. ইয়োখেন ফ্রুবিখের সঙ্গে ইভাপোরিমিটার নিয়ে কথা বলছেন লেখক। ছবি: হৃদয়ে মাটি ও মানুষ

কৃষি গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে নেদারল্যান্ডস বিশ্বজুড়ে সুপরিচিত। আগামীর কৃষিকে টিকিয়ে রাখা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশটি দীর্ঘদিন ধরেই বহুমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করে আসছে। সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত সহায়তায় কৃষিপ্রযুক্তির উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে যে প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ ভূমিকা রাখছে, তাদের মধ্যে রয়্যাল আইকোলকাম্প একটি উল্লেখযোগ্য নাম। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপক কার্যক্রম সরেজমিনে পর্যবেক্ষণের সুযোগ হয়েছিল।

১১১ বছরের ঐতিহ্য বহনকারী রয়্যাল আইকোলকাম্প মূলত একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে ছয়-সাত হেক্টর বিস্তৃত জমিতে তারা পরিচালনা করছে প্রযুক্তিভিত্তিক নানাবিধ কার্যক্রম। কৃষিতে ব্যবহৃত আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং বিভিন্ন উপকরণের নকশা, নির্মাণ ও ম্যানুফ্যাকচারিং তাদের প্রধান ব্যবসা হলেও, পাশাপাশি মাটি, পানি, আবহাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বহুমাত্রিক প্রভাব নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি ধারাবাহিকভাবে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে।

এপ্রিলের এক সোনালি বিকেলে আমি আমার টিমসহ উপস্থিত হয়েছিলাম নেদারল্যান্ডসের গিসব্যাক এলাকায় অবস্থিত রয়্যাল আইকোলকাম্প একাডেমিতে। সেখানে আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ফোন্স আইকোলকাম্প এবং কয়েকজন গবেষক। ফোন্স আমাদের নিয়ে গেলেন একটি দ্বিতল ভবনে, যেখানে কৃষির মৌলিক ভিত্তি ‘মাটি ও পানি’ নিয়ে তাঁদের প্রায় সব গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়নকর্ম সম্পন্ন হয়। মাটির স্বাস্থ্য, পানির গুণাগুণ ও প্রকৃত চাহিদা বিশ্লেষণের জন্য ব্যবহার হওয়া আধুনিক সব যন্ত্রপাতি সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো। প্রতিটি যন্ত্রের কার্যকারিতা, প্রয়োজনীয়তা ও কৃষি উৎপাদনে এর ব্যবহার নিয়ে ফোন্স বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন।

ফোন্স দেখালেন বিভিন্ন ধরনের সেন্সর। যেগুলো রিয়েল-টাইমে জানায় মাটির রাসায়নিক গুণাগুণ, পানির স্তর, আর্দ্রতা, এমনকি মাটিতে পানির লবণাক্ততা বা দূষণের মতো সূক্ষ্মতম তথ্যও। একটি বিশেষ সেন্সর দেখিয়ে ফোন্স বললেন, এই সেন্সরটা মাটির ১৫০ থেকে ২০০ মিটার গভীরে বসানো হয়। সেখান থেকে পাওয়া তথ্য সরাসরি চলে যায় কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনে। অফিসে বসেই আপনি সেচ ব্যবস্থাপনা করতে পারবেন, মাঠে উপস্থিত থাকার প্রয়োজন নেই।

ফোন্স আমাদের দেখালেন মাটিক্ষয় নির্ণায়ক একটি সেন্সরও। সেন্সরটিতে স্থাপন করা রয়েছে অত্যন্ত সংবেদনশীল মাইক্রোফোন, যা বাতাসে মাটি কতটা আলগা হচ্ছে, কত গতিতে মাটির কণা বাতাসে আঘাত করছে, এসব বিশ্লেষণের মাধ্যমে জমির ক্ষয়মাত্রা নির্ণয় করতে পারে। অথচ আমাদের দেশে এখনো অধিকাংশ কৃষকই মাটি পরীক্ষা ছাড়া চাষাবাদ করেন। ফলে অপ্রয়োজনীয় সার ব্যবহার, খরচ বৃদ্ধি ও ফলন হ্রাস—সবই একসঙ্গে ঘটে। এসব দেখে আমি ভাবছিলাম, নিয়মিত মাটি পরীক্ষা চালু করা গেলে আমাদের কৃষিকাজে কত বড় পরিবর্তন আনা সম্ভব হতো!

এরপর ফোন্স আমাদের নিয়ে গেলেন ইনোফিল্ডস নামে আরেকটি অংশে, যা মূলত উদ্ভাবনী কৃষিপ্রযুক্তির পরীক্ষাগার। কোন ভূমিতে কৃষি, কোন জায়গায় শিল্প বা বাসস্থান হবে, তা বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে নির্ধারণ করাও তাঁদের একটি বড় কাজ। যাওয়ার পথে ফোন্স জানালেন, ১৯১১ সালে তাঁর দাদা ছিলেন এলাকার দক্ষ কামার। তাঁর হাত ধরেই কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। ক্রমে যান্ত্রিক কৃষির বিবর্তন, আধুনিকীকরণ এবং পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারা ধরে আজ ফোন্স নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রতিষ্ঠানের। তাঁর কাছে আধুনিক কৃষি মানেই প্রযুক্তিনির্ভর, দক্ষতাভিত্তিক কৃষিকাজ, যেখানে কায়িক শ্রমের তুলনায় কারিগরি জ্ঞান অনেক বেশি প্রয়োজন। তাই তরুণেরাও আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসছে।

ইনোফিল্ডসে গিয়ে পরিচয় হলো তরুণ বিজনেস লাইন ম্যানেজার বব ক্লাইন লাংকহর্সটের সঙ্গে। তিনি আমাদের দেখালেন ‘ফার্মবোট’ নামে এক অভিনব রোবট। এই রোবটটি বীজ বুনন থেকে সেচ দেওয়া, আগাছা পরিষ্কার করা, তদারকি—সবকিছুই স্বয়ংক্রিয়ভাবে করতে সক্ষম। বব বললেন, ‘রোবট আগাছা পরিষ্কার করায় কেমিক্যাল ব্যবহারের দরকার নেই। আমরা মাটিতে জৈব সার ব্যবহার করি, কোনো রাসায়নিক সার বা কীটনাশকের ওপর নির্ভরশীল নই। প্রকৃতি যেমন নিজের মাটি নিজেই পুনরুজ্জীবিত করে, আমরা প্রযুক্তির সাহায্যে ঠিক সেটাই করছি, তবে রাসায়নিক ছাড়া। শার্ট-প্যান্ট পরে এই কৃষি করা সম্ভব বলে তরুণেরা খুব আগ্রহী এই কাজে। আমরা একে বলছি “সেক্সি অ্যাগ্রিকালচার”।’

বব ক্লাইন আমাদের নিয়ে গেলেন তাঁদের ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদনের স্থানে। সেখানে কেঁচোসমৃদ্ধ এক প্লট দেখিয়ে বব বললেন, এগুলো দেখুন, কী সুন্দর সুস্থ কেঁচো! এদের খাবার পর্যাপ্ত আছে, আর খাওয়া শেষে এদের বর্জ্য মাটিকে ফিরিয়ে দেয় সমৃদ্ধ জৈবগুণ। মাটির আর্দ্রতাও ঠিকঠাক আছে। এতে প্রচুর কার্বন আছে, যা জলবায়ুর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কারণ, মাটিতে কার্বনের পরিমাণ যত বেশি থাকে, মাটি তত বেশি পানি ধারণ করতে পারে।

পরবর্তী পর্যায়ে আমরা পৌঁছালাম মাটির জীববিজ্ঞান গবেষণাগারে, যার দায়িত্বে ছিলেন স্তেরা আইটারাইক। তিনি আমাদের দেখালেন সয়েল বায়োলজি অ্যানালাইসিস। মাইক্রোস্কোপে দেখা গেল নেমাটোড, ব্যাকটেরিয়া, অণুজীব, মিনারেল। কেমিক্যাল ইনপুট ছাড়াই মাটির নিজস্ব জীববৈচিত্র্য কতটা শক্তিশালী এবং ফসল উৎপাদনে কীভাবে ভূমিকা রাখে, তা খুব দক্ষতার সঙ্গে ব্যাখ্যা করলেন স্তেরা।

গবেষণাগার থেকে বের হয়ে ফোন্স আমাদের নিয়ে গেলেন মাঠে। দেখালেন সোলার এনার্জিতে চলা রেইনফল ডিটেক্টর। এটি এমন এক যন্ত্র, যা বৃষ্টির পরিমাণ, বাতাসের গতি ইত্যাদি সম্পর্কে সম্যক তথ্য দেয়। বিজনেস ইনোভেশন স্ট্র্যাটেজি বিভাগের ড. ইয়োখেন ফ্রুবিখ জানালেন, মাঠে স্থাপিত ইভাপোরিমিটারের তথ্য অনুযায়ী, নেদারল্যান্ডসে মোট বৃষ্টির প্রায় ৬৫ শতাংশ বাষ্পীভূত হয়ে যায়। মাটিতে কত পানি আছে, কত দরকার, বৃষ্টির পানি কতটা ধরে রাখতে পারছে—এসব তথ্য কৃষিকাজের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফোন্স বললেন, ‘ছয় বছর আগে ইভাপোরিমিটার আবিষ্কার না হলে আমরা জানতেই পারতাম না যে দেশের এতটা বৃষ্টির পানি বাষ্পে মিলিয়ে যায়।’

সেন্সরগুলো থেকে প্রাপ্ত রিয়েল-টাইম তথ্য তাঁদের কন্ট্রোল সেন্টারে পাঠানো হয়, যেখানে সব ডেটা বিশ্লেষণ করে স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্ত দেওয়া হয় সেচ ব্যবস্থাপনা, পানির ভারসাম্য বজায় রাখা এবং মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়ে। এতে কৃষকের মাঠে উপস্থিত থাকার প্রয়োজন কমে গেছে। অফিসে বসেই কৃষিকাজের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব।

এই প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি তরুণদের কাছে ক্রমে আকর্ষণীয় পেশায় পরিণত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রযুক্তির ব্যবহার যে কতটা কার্যকর, রয়্যাল আইকোলকাম্প তার জীবন্ত উদাহরণ। তারা পৃথিবীর সব সম্ভাব্য হাইড্রোলজিকাল এক্সপেরিমেন্টের তথ্য সংগ্রহ করছে, পরিবেশবান্ধব কৃষির ভবিষ্যৎও গড়ে তুলছে।

আগামীর কৃষি হবে নিঃসন্দেহে প্রযুক্তির কৃষি—এ উপলব্ধি থেকেই নেদারল্যান্ডস বহু পথ এগিয়ে। জলবায়ু পরিবর্তন সামনে রেখে তারা তৈরি করছে নতুন কৃষি-ধারণা, নতুন মডেল। ঐতিহ্যবাহী কৃষি আর উদীয়মান নগরকৃষির সমন্বয়ে তারা তৈরি করছে ভবিষ্যতের কৃষিব্যবস্থা। কৃষি তাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি—এ সত্য আরও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে রয়্যাল আইকোলকাম্পের কর্মদর্শনে। আমাদের কৃষি গবেষণা, অনুশীলন এবং কৃষি-বাণিজ্যের উন্নয়নে প্রতিষ্ঠানটির এ পথচলা হতে পারে অনুপ্রেরণার অশেষ উৎস।

লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান চ্যানেল আই

এভাবে চলতে থাকলে কি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে

প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্বের গুরুত্ব

সংকট, সম্ভাবনার সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ

গণতন্ত্রের সন্ধিক্ষণ: তারেক রহমানের দেশে ফেরা

কেন পুড়িয়ে মারার মধ্যযুগীয় বর্বরতা

তারেকের প্রত্যাবর্তন: রাজনৈতিক ভবিষ্যতের এক মাহেন্দ্রক্ষণ

বিশ্বজুড়েই কেন গণমাধ্যম আক্রান্ত

সাইবার যুদ্ধ ও নজরদারি প্রযুক্তি: বৈশ্বিক নিরাপত্তা কোন পথে

মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে তুরস্কের নয়া ভূমিকা

রাষ্ট্রের মালিকানা এল না জনগণের হাতে