ঈদের সন্ধ্যারাত। রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার একটি গ্রাম। বাজারে চায়ের দোকানে বাঁশের টংয়ের ওপর বসে গ্রামীণ কর্মজীবী ১৫ জনের একটি দল রসিয়ে রসিয়ে ঈদ আড্ডা দিচ্ছে। কখনো বা তাঁরা প্রাণখুলে হাসছেন। চা-বিস্কুট খাচ্ছেন। পাশে চেয়ারে কয়েকজন বিত্তবান মানুষ। এমন সময় এলাকার দুজন বাম কমিউনিস্ট বন্ধুকে নিয়ে সেখানে গেলেন ওই গ্রামেরই সাবেক কমিউনিস্ট ও বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা আমজাদ হোসেন সরকার। করোনাভাইরাসের কারণে এক বছরের বেশি গ্রামে যান না। ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর ‘কেমন আছো?’ প্রশ্নের উত্তরে তাঁদের একজন জবাব দিলেন, ‘বেশ ভালো আছি আমরা। এখন দিনমজুরি করি না। আগের মতো আলাদা আলাদাভাবে কিষানি দিই না। আমরা ইচ্ছামতো কাজ করি। কাজের পেছনে ছুটি না। কাজ আমাদের পিছু পিছু ছোটে।’
এমন কথায় কিছুই বুঝতে পারেন না আমজাদ। শ্রমজীবীরা মিটিমিটি হাসছেন। বিত্তবানদের একজন বললেন, ‘ওদের ১০ জন মিলে টিম আছে। ওরা দৈনিক হাজিরায় কাজ করে না। গৃহস্থ বাড়ির কাজ ওরা দলবদ্ধ হয়ে চুক্তির ভিত্তিতে করে। এতে মালিক কোনো বাড়তি আদেশ–নির্দেশ দিতে পারেন না। দলটি মাঠে যায়। দ্রুতই কাজ শেষ করে। একদিনে দু–তিনটি চুক্তির কাজ করে। বিকেল চারটার মধ্যে বাড়ি ফেরে।’ কত রোজগার হয়? এমন প্রশ্নের উত্তরে শ্রমজীবীরা বললেন, কমপক্ষে ৫০০ টাকা থেকে ১০০০–১২০০ টাকা পর্যন্ত হয়। সারা বছর কাজ পাই। উল্টো রাগ বা অভিমান করলে গৃহস্থকে তৈলমর্দন করতে হয়। অভাব কি আছে গ্রামে? উত্তরে তাঁরা জানালেন, গ্রামে অভাব নেই। আধপেটা খাওয়ার লোক নেই। শ্রমজীবী অনেকের ঘরে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত সঞ্চয় আছে। আমজাদ মন্তব্যে করলেন, ‘এমন চিত্র ১০ বছর আগে ছিল না।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এই পোস্টটি পড়ে বিস্ময়ে অভিভূত হলাম। আশির দশকে ওই গ্রামগুলোতে ঘুরেছি। সন্ধ্যার পর তখনকার গ্রামের চিত্র মনের চোখে ভেসে উঠল। ভাবলাম ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ে ওঠার যে চিত্র তখন স্বপ্নে দেখতাম, তার দিকে কি ধাবমান বাংলাদেশ! করোনার মধ্যেও চরম দারিদ্র্য কমে অভাব কি সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে! ওই পোস্টে আমি বাদে চারজন কমেন্ট করেছেন। ময়মনসিংহের সাবেক কমিউনিস্ট নেতা ও গ্রামপর্যায়ে সামাজিক তৎপরতায় বহুলভাবে যুক্ত প্রদীপ চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘বস্তুনিষ্ঠ চিত্র। সমসাময়িক পরিবর্তন সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা নেই।’ দিনাজপুরের সাবেক কমিউনিস্ট ও বর্তমানে আওয়ামী লীগ ও সামাজিক আন্দোলনের নেতা আবুল কালাম আজাদ লিখেছেন, ‘সমাজে শ্রমজীবী মানুষের এভাবেই বিস্তার হচ্ছে। ফলে বদলে গেছে তাঁদের জীবনের চিরচেনা কর্মের ধারা। শ্রমজীবী পরিবারগুলোতে সন্তানদের সংখ্যা দুইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। স্ত্রীসঙ্গ এখন তাঁদের একমাত্র বিনোদনমাধ্যম নয়। রাত ১২টা পর্যন্ত মোড়ের চায়ের দোকানে টিভি দেখে ঘুমকাতুরে ঢুলুঢুলু চোখে ঘরে ফিরে ঘুম দেয়।’ রংপুরেরই সাবেক কমিউনিস্ট নেতা ও সামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত মাসুম হাসান লিখেছেন, ‘পরিবর্তন তাৎপর্যপূর্ণ।’ কুড়িগ্রাম জেলার সামাজিক কর্মী নুরুল হাবিব পাভেল লিখেছেন, ‘লক্ষণীয় পরিবর্তন।’
এই ফেসবুকে পোস্টে যে ২০ জন লাইক দিয়েছেন, তাঁদের কমবেশি আমি চিনি। সবার সঙ্গেই যোগাযোগ রয়েছে। এই ঘটনাটা পড়ার পর ইন্টারনেটের সুবাদে তৃণমূলের কয়েকটি জেলার সাবেক-বর্তমান রাজনৈতিক বন্ধু এবং রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন, এমন কয়েকজনের কাছে টেলিফোন করলাম। মানুষের অভাব-অভিযোগ রয়েছে বললেও তাঁরা সবাই যা বললেন, তা নতুন একটি বাংলাদেশ গড়ে ওঠার ধারণার সঙ্গে কমবেশি মিলে গেল। অনেকেই গ্রামীণ মহিলাদের অর্থ উপার্জনের কথার বিবরণ দিলেন। হাঁস–মুরগি, গরু–ছাগল ঘরে ঘরে। খেতেও তাঁরা কাজ করছেন। কেউ কেউ বললেন, গ্রামের শ্রমজীবী পরিবারের কোনো কোনো সদস্য থানাসদর বা শহরে কাজ করে গ্রামে টাকা পাঠান। পেটে-ভাতে গ্রামবাংলার শ্রমজীবীরা আছেন—এটাই হচ্ছে সবার কথার সংক্ষিপ্তসার।
এমনটাও জানলাম, গ্রামে কম্বাইন্ড হারভেস্টার এসে গেছে। কাদামাটিতে পড়ে থাকা ধান কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই শেষ করছে। যন্ত্রটি কিনতে সরকারের কৃষি ভর্তুকির সুযোগ এখন অনেকেই নিচ্ছেন। এসব খবর পেয়ে ঈদের মধ্যে কৃষিবিদ কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের ফেসবুক পোস্টগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়লাম। জানলাম লকডাউনে কৃষি মন্ত্রণালয় ও মাঠপর্যায়ে কৃষি অফিস খোলা থাকছে বোরো ধান কাটার আগে হারভেস্টার, রিপেয়ারসহ কৃষিযন্ত্র বিতরণে সহযোগিতার জন্য। চালু রয়েছে মনিটরিং সেল। সরকারি অফিসগুলোর আমলাতন্ত্র সম্পর্কে ধারণা কারও ভালো থাকার কথা নয়। কিন্তু যদি সরকারি সাহায্য কৃষিমন্ত্রীর কথামতো কমবেশি তৃণমূলে সফলভাবে পৌঁছে থাকে, তবে বলতেই হবে—সাফল্যের গ্যারান্টির একটি দিক সরকার আর কৃষকের বন্ধন ক্রমে জোরদার হচ্ছে। একেই বলে কৃষিবান্ধব সরকার। মনে হচ্ছে—আত্মবিশ্বাস থাকার কারণেই কৃষিমন্ত্রী বলতে পারছেন, ‘বোরো ধান ঘরে তুলতে পারলে দেশে খাদ্যসংকট থাকবে না।’ ‘তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ’ ‘পি-এল ৪৮০ খাদ্য নিয়ে রাজনীতির তাস খেলার দেশ’ বাংলাদেশ ৫০ বছরে আজ করোনাভাইরাসের মধ্যেও মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। চলমান সমস্যা-সংকটের মধ্যেও রয়েল বেঙ্গল টাইগার যেন গর্জনে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে।
বলা বাহুল্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা নামীদামি পত্রিকায় ঈদের দিনগুলোর ঘটনা বর্ণনায় দেশের নেতিবাচক চিত্র বেশি পরিমাণে খুঁজে পাওয়া যাবে। ‘সবার জন্য আনন্দের বার্তা নয়’ এমন শিরোনামের লেখাও পড়েছি। জেনেছি করোনাকালে বেশির ভাগ মানুষই বিষাদের ঈদ উদযাপন করেছেন। হররোজই রোজা যাঁদের জীবন, তাঁদের আবার ঈদ কী! এমন প্রশ্নও উঠেছে। ঈদের সময় ঈদের ইবাদত-আনন্দ পরিবার–পরিজনদের সঙ্গে পালন করার জন্য নয়, বস্তিতে থাকার কারণে শহর ছেড়ে গ্রামে পালাতে চাইছেন শ্রমজীবী মানুষ—এমন কথাও প্রচার হয়েছে। আমি জনগণের গ্রামে যাওয়ার সমালোচনাও পড়লাম। বিষয়টি পালানো বা সমালোচনার বিষয় কি না তা নিয়ে ভাবলাম। মনে পড়ল, সামাজিক মনস্তত্ত্বের অন্যতম মূল কথা— ‘এটা কারও ইচ্ছা–অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে না।’
বাস্তবে দুই দিকে দুই বাংলাদেশের চিত্র পড়ে অনেক সময়েই বিভ্রান্তি বা দোদুল্যমানতায় পড়ে যাই। অনেক সময়েই মনে হয়, চারণের বেশে গ্রামবাংলায় ঘুরে প্রয়াত সত্যেন সেনের মতো ‘গ্রামবাংলার পথে পথে’ কিংবা প্রয়াত মোনাজাতউদ্দিনের মতো ‘পথ থেকে পথে’ ধরনের সাংবাদিক আমাদের খুব দরকার। আশির দশকে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ‘সংগ্রাম-সংগঠন: অতীত-বর্তমান’ কলাম লিখতাম। এখন তো আর গ্রামে গ্রামে ঘোরার সুযোগ নেই। এটাই আক্ষেপ, বিভ্রান্তি আর দোদুল্যমানতার কারণ বলে মনে হলো।
কথায় বলে, চোখে যদি থাকে কালো, লাল বা স্বচ্ছ চশমা, তবে তেমনই দেখা যায় জগৎকে। বাস্তবে দেশ তো রাজনীতিতে বহুধা বিভক্ত। এককথায় সরকারপক্ষ ও বিরোধীপক্ষ। তাই তৃণমূলের অর্থনৈতিক অবস্থার একই চিত্র ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়। তথ্য ও পরিসংখ্যান তখন মানা কিংবা না মানার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এ ব্যাপারে বিবেকের ভূমিকা পালন করতে পারে দেশের সংবাদপত্র ও সুশীল সমাজ। কিন্তু সুশীল সমাজ কিংবা বিবেক সমাজ এখন আছে কি না—এ প্রশ্ন ওঠাটাই সংগত। এখন নিরপেক্ষ দাবিদার সুশীল সমাজ থেকে বলা হচ্ছে, বিএনপিকে রাজনীতি করতে দেওয়া হচ্ছে না। বর্তমানের ‘ভদ্রলোকের রাজনীতির দুই পক্ষই’ একটি অন্যায়কে আর একটি অন্যায় দিয়ে জায়েজ করছে বলে অভিযোগ তোলা হচ্ছে। কিন্তু ২০০৭-০৮ সময়কালে যখন সেনাসমর্থিত সুশীল সমাজ রাজনীতি থেকে দুই নেত্রীকেই ‘মাইনাস’ করতে চেয়েছিল, তখন কী হয়েছিল? সেটা কোন কায়দা ছিল? দুই দলকেই ‘ফ্যাসিস্ট’ বলা হচ্ছে। কিন্তু ওই দুই দলের সঙ্গে তো গণমানুষ বিভক্ত হয়ে আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সে সময়ে কি মানুষ ওই সরকারের সঙ্গে ছিল?
বলা বাহুল্য, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়টি রাজনৈতিক পাল্টাপাল্টি বা তর্ক-বিতর্কের নয়। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্যই দেশ-জাতি-জনগণের উন্নতি ও সমৃদ্ধির বাস্তব চিত্র উঠে আসাটা প্রয়োজন। ওপরে উঠতে হলে এ কথা বোঝার বিকল্প নেই যে নামছি না উঠছি। জাতির অর্জন ও সাফল্যকে অর্জন বলে বিবেচনায় না নিলে কিন্তু ষোলো আনাই ফাঁকি হয়ে যায়। করোনাদুর্যোগে অর্থনীতির বাস্তবতায় প্রধানমন্ত্রী দরিদ্র মানুষদের এক বছরে আড়াই হাজার টাকা করে দুই কিস্তিতে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছেন। এক বছরে পাঁচ হাজার টাকা এমন কিছু নয়—এটা সবাই বোঝে। কিন্তু প্রশ্নটি হচ্ছে, জাতীয় সামর্থ্য ও সদিচ্ছার। এ দিকটি স্পস্ট হচ্ছে বলেই তো মনে হয়।
এ দুই থাকার কারণেই আজ সরকার কেবল পদ্মা সেতু নিজ অর্থায়নে নয়, অসহায় মানুষের পাশেও দাঁড়াতে পারছে। বিদ্যুৎ ট্রেন চলছে, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পরিবার মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছে, বিদ্যুৎ সংকট দূর হয়েছে, সামাজিক সাহায্যের বেষ্টনী, দুস্থ ভাতা, বিধবা ভাতা প্রভৃতি আমরা বাড়াতে পারছি। করোনা আমাদের অর্থনীতিকে তেমনভাবে কাবু করতে পারেনি। তবে বৈষম্যের বিষয়টি রয়ে গেছে। রয়েছে ভোট-গণতন্ত্র আর রাজনৈতিক সমস্যা। আছে বহুবিধ সামাজিক অবক্ষয়, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও উগ্রবাদীদের সন্ত্রাসী তৎপরতার সমস্যা। রয়েছে পদপিষ্ট হয়ে বা দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সমস্যা। এটা তো ঠিক, এসব না থাকলে করোনা সত্ত্বেও ঘরে ঘরে ঈদের আনন্দ আরও নতুন রূপে আবির্ভূত হতো।
যদি না থাকত ঢাকায় ফিরে আসবে কীভাবে কিংবা কত খরচ হবে—এমন শঙ্কা, তবে আর ভালো হতো। কিন্তু কিই বা করার আছে? যানবাহন খুলে দিলে করোনার বিপদ, আর না দিলে মানুষের দুর্ভোগ। এ দিকটি বিবেচনায় সরকার রয়েছে শাঁখের করাতের মধ্যে।
এদিকে বলতেই হয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হৃদয়বিদারক ও নিন্দনীয় কিছু ঘটনা ঈদ উৎসবকে ম্লান করে দিয়েছে। করোনা দুর্যোগের মধ্যেও মধ্যপ্রাচ্যের গাজা কিংবা কাবুলের মসজিদে হামলা ও মৃত্যু আসলেই মেনে নেওয়া যায় না। দেশ ও বিশ্ব থেকে করোনাভাইরাসসহ অন্ধকার দূর হোক, সব ধর্মমতের মানুষ যার যার উৎসব–আনন্দ নির্বিঘ্নে পালন করুক, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ও হিংসা দূর হোক—এটাই কামনা।