সম্প্রতি শহীদ মিনারের পাদদেশ থেকে ঢাকার রাজপথে শিক্ষকদের দুর্বার আন্দোলন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। শত শত ছাত্রের শিক্ষাগুরুদের আন্দোলনকে দমন করতে পুলিশকেও সক্রিয় হতে দেখা গেছে। আন্দোলনটি বেতন-ভাতা ও সম্মানের জন্য। মূলত বেতন-ভাতাটিই মুখ্য। আমরা যাঁরা গত শতাব্দীর পঞ্চাশ এবং ষাট দশকের ছাত্র, তাঁরা দেখেছি অধিকাংশ শিক্ষক এক অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে এই মহান কাজটির সঙ্গে যুক্ত আছেন। সেই সময়ই আমাদের পাঠ্যপুস্তকে তালেব মাস্টার কবিতাটি পড়তে হতো।
প্রাথমিকের কিছু স্কুল সরকারীকরণ হলেও সেসবের বেতন হতো অনিয়মিত। অনেক দিন পর পর বেতন পেতেন শিক্ষকেরা। কিন্তু শিক্ষকদের সম্মান ছিল। একধরনের ব্রত নিয়ে তাঁরা কাজ করতেন। আবার কিছু মানুষ সম্পন্ন পারিবারিক ঐতিহ্য থেকেও এই পেশায় আসতেন। কিন্তু শিক্ষক তাঁর কর্তব্যে অবহেলা করতেন না, শিক্ষাকে যতটা সম্ভব আনন্দময় করার চেষ্টা করতেন। সমাজের ন্যায়-অন্যায়ের পাহারাদারও ছিলেন তাঁরা।
কালক্রমে যখন অর্থই সামাজিক মর্যাদার মানদণ্ড হয়ে দাঁড়াল, তখন থেকেই শিক্ষকের সম্মানেও ভাটা পড়ল। সরকারি অফিসের পিয়ন এবং শিক্ষকের বেতন একই স্কেলে এসে পড়ল। এই অপমান নিয়েও তাঁরা কাজ করে গেছেন। কোনো এক আমলা-মন্ত্রীর সদিচ্ছায় বেতন-ভাতা একটু বাড়ল। উচ্চশিক্ষিত তরুণদের শিক্ষকতা পেশায় নিয়ে আসার জন্য একটু চেষ্টা-চরিত্রও হলো। কিন্তু শিক্ষা প্রশাসনে একটা আমলাতন্ত্রও চাপিয়ে দেওয়া হলো, যেখানে শিক্ষকেরা নেই। থানা থেকে জেলা পর্যন্ত সরকারি নিয়োগের মাধ্যমে কিছু কর্মকর্তা নিয়োগ করা হলো, যাঁরা কখনোই শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।
অবমাননাকর এই ব্যবস্থা শিক্ষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি প্রবলভাবে ঢুকে যাওয়ার কারণও এটি। রাজনৈতিক দলের সদস্যরাও এই ব্যবস্থায় স্কুল ম্যানেজমেন্টে একটা স্থায়ী আসন পেয়ে গেলেন। আমাদের শাসকগোষ্ঠী শিক্ষার বিষয়ে কখনো মনোযোগী ছিল না। মেধাবী ছাত্রদের প্রাথমিক শিক্ষায় আকর্ষণ করার কোনো চেষ্টাই করেনি। শিক্ষার বিষয়ে সব মনোযোগ বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক, যেখান থেকে কলেজ পর্যন্ত তার বিস্তৃতি। দলীয় রাজনীতির বৃত্তে নিয়ে আসার এক মরণপণ সংগ্রাম সেখানে। অথচ কিছু শিক্ষাবিদ (!) যাঁরা সরকার কর্তৃক মনোনীত দলীয় আনুগত্যের কারণেই তাঁরা নিয়োগ পান। তাঁদের তৈরি সিলেবাসও পাঠ্যক্রমে যুক্ত হয়। কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনও সেখানে অবহেলিত। ক্ষতবিক্ষত সংবিধানের মতোই পাঠ্যক্রমও রাজনৈতিক দলের অভিলাষেই নিয়ন্ত্রণ করা হয়। শিক্ষকদের মধ্যেও একটা রাজনৈতিক মেরুকরণ হতে থাকে।
আমি আজ থেকে ৪০ বছর আগে জাপানে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রাথমিক স্কুলগুলো দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। লেখাপড়ার মধ্যে সৃজনশীল মাধ্যম যেমন সংগীত, কাব্য, নাটক, ছবি আঁকা—এসব ব্যবহার করা হয়। বিজ্ঞানের কঠিন সূত্রগুলোও সৃজনশীল মাধ্যমের দ্বারা বোঝানো হয়। স্কুলগুলোতে নিয়মিত ক্রীড়ার অনুশীলনও হয়ে থাকে। শিক্ষকেরা সম্মানজনক বেতন-ভাতা ও পদোন্নতি পেয়ে থাকেন এবং সব সময় শিক্ষাবিষয়ক সব সিদ্ধান্ত শিক্ষকেরাই নিয়ে থাকেন।
তার আগে এবং পরেও অনেক দেশের স্কুলগুলোতেও অনুরূপ ব্যবস্থা দেখেছি। আমাদের দেশেও প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে একই রকমভাবে সৃজনশীল মাধ্যমগুলো ব্যবহারের জন্য পিটিআই বা টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলো প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ব্যবস্থা থাকলেও মাঠপর্যায়ে এসবের ব্যবহার কোনো কার্যকর অবস্থায় যেতে পারেনি। জাপান থেকে ফিরে এসে এই ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে বিভিন্ন দুয়ারে ধরনা দিয়েছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত ইউনিসেফ সাড়া দিল, তা-ও একজন বড় কর্মকর্তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে। প্রাইমারি অধিদপ্তরের সঙ্গে ইউনিসেফ এই প্রকল্পটি গ্রহণ করে। ৬৪ জেলায় কর্মশালার মাধ্যমে প্রশিক্ষণটি দেওয়া হয়। প্রাথমিক শিক্ষক এবং সংস্কৃতিকর্মীদের অংশগ্রহণ সেখানে নিশ্চিত করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে বিষয়টি উত্থাপিত করা হয়নি। কিছু আর্থিক বিষয় ছিল বলে দুর্নীতিও ঢুকে পড়ে। এর মধ্যে ঢুকে গেছে নানা স্তরের শিক্ষাব্যবস্থা। ইংরেজি শিক্ষার জন্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়; ধর্মীয় শিক্ষার জন্য মাদ্রাসা এবং আরও একধরনের শিক্ষা হয়ে থাকল ক্যাডেট কলেজ। শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই একধরনের পশ্চিমা আমলের শ্রেণিবিন্যাস করা হলো। কিন্তু কোটি কোটি শিক্ষার্থী শিক্ষার প্রবেশদ্বারেই থেকে গেল অবহেলিত।
প্রাথমিক শিক্ষায় উন্নত দেশে নারী শিক্ষকদের অংশগ্রহণ প্রয়োজন এবং সে ব্যবস্থাও সেখানে আছে। আর এরই মধ্যে শিক্ষায় অভিশাপ হিসেবে এসেছে কোচিং। অল্পবিত্তের মানুষের সন্তানসন্ততিদের যতই মেধা থাকুক না কেন, তাদের স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হওয়ার ব্যবস্থা। স্কুলে লেখাপড়া হচ্ছে না, কোচিং সেন্টারে রমরমা ব্যবসার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। মুষ্টিমেয় কিছুসংখ্যক আছেন, যাঁরা এই ব্যবস্থায় পা দেননি, কিন্তু তাঁরা একঘরে।
শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়াতেই হবে এবং সরকারি শ্রেণিবিন্যাসের একটা জায়গায় নিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। ব্যবস্থাটাকে ঢেলে সাজাতে হবে। শিক্ষকতা মানে একটা চাকরি শুধু নয়, একটা মহান পেশার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করার কাজটিও তাঁদের করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একেবারে প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিভাবক, ভালো শিক্ষক, জনগণ, এমনকি ছাত্রদেরও অনেক অভিযোগের পাহাড় জমেছে। দেশের বিদ্যমান অপরাজনীতির অংশ হিসেবে শিক্ষকেরাও যেন ব্যবহৃত না হন, সে ব্যাপারেও সচেতন থাকা জরুরি। শাসকগোষ্ঠী এবং সচেতন জনগণকেও বিষয়টি এক বড় সমস্যা হিসেবে দেখা প্রয়োজন।