হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

রাজনীতির মাঠে অকস্মাৎ বাউলা বাতাস

নির্বাচন বিলম্বিত করার একটি চেষ্টায় কোনো না কোনো শক্তি সক্রিয় রয়েছে। ধারণা করা খুবই সংগত যে ওই শক্তি এতটাই বেপরোয়া, নির্বাচন পেছানোর জন্য সরকার পরিবর্তনেও তারা পিছপা হবে না।

অরুণ কর্মকার

রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং জনপরিসরে কিছুটা সন্দেহ-সংশয় থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বারবারই নিশ্চিত করা হয়েছে যে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই সেদিনও ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধিদলকে প্রধান উপদেষ্টা বললেন, ফেব্রুয়ারিতে উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে এর পাশাপাশি সম্প্রতি সরকারসংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ বলতে শুরু করেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে দেশ গভীর সংকটে পড়বে। সর্বশেষ এই কথাটি শোনা গেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের মুখ থেকেও। তাঁরা যখন ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না ‘হলে’র মতো কথা বলেন, তখন ধরে নেওয়া যায় যে না হওয়ার মতো কোনো আলামত বা উপাদান তাঁরা দেখছেন। না হলে তাঁরা এমন কথা বলবেনই-বা কেন!

কিন্তু ‘যদি’ যুক্ত করে হলেও কেন নির্বাচন না হওয়ার প্রসঙ্গ উঠেছে বা ওঠানো হয়েছে, তা ছিল অস্পষ্ট। অর্থাৎ সে কথা কেউই বলছিলেন না। কিন্তু বিভিন্ন মহলে কিছু কানাঘুষা ছিল। তার মর্মার্থ হলো, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে অন্তর্বর্তী সরকারের কাঠামোই পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে গঠিত হতে পারে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এই কানাঘুষার মধ্যেই সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলো যে অন্তর্বর্তী সরকারে একটা পরিবর্তন আসছে। তাতে কয়েকজন উপদেষ্টা বাদ পড়বেন, যাঁরা ফেব্রুয়ারির নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার পক্ষে। তাঁদের স্থলে নতুন উপদেষ্টা নিয়োগ করা হবে। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবর্তে গঠিত হতে পারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারও।

এই যে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে আগামী ফেব্রুয়ারির সম্ভাব্য নির্বাচন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের কথিত বা কল্পিত পরিবর্তন নিয়ে কথাবার্তা, তা যে একেবারে ভিত্তিহীন নয়, তা বোঝা গেল গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খানের এক ফেসবুক

পোস্টে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে রাশেদ খান এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস স্যারের সমালোচনা আমিও করেছি। সামনেও করব। কিন্তু তাঁকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে কিংবা অন্তর্বর্তী সরকার ভেঙে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পক্ষে আমি নই।’

এর কারণও রাশেদ বলেছেন। ফেসবুকে তিনি লেখেন, ‘এর কারণ হলো নতুন করে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে গেলে গণ-অভ্যুত্থানের অংশীদার রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে না, বরং বিভাজন বাড়বে। সেই সুযোগে বাংলাদেশে আরেকটি ১/১১ নেমে আসবে। সে

ক্ষেত্রে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারে অংশ নেওয়ার অপরাধে ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ সকল উপদেষ্টাকে গ্রেপ্তার করা হবে। গণ-অভ্যুত্থানের অংশীজনদের রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে পাকড়াও করা হবে।’ আরও কিছু কথা তিনি লিখেছেন। তবে তাঁর সব কথার মোদ্দা কথা হলো—বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ভেঙে দিয়ে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের যে কানাঘুষা শোনা গেছে, তার কিছুটা হলেও ভিত্তি আছে। আর এর পেছনের কারণ হচ্ছে আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচন না হওয়া বা পিছিয়ে যাওয়া।

এই পটভূমিতে এ কথাও অস্বীকার করার কোনো উপায় থাকে না যে নির্বাচন বিলম্বিত করার একটি চেষ্টায় কোনো না কোনো শক্তি সক্রিয় রয়েছে। ধারণা করা খুবই সংগত যে ওই শক্তি এতটাই বেপরোয়া, নির্বাচন পেছানোর জন্য সরকার পরিবর্তনেও তারা পিছপা হবে না। অবশ্য এ ধরনের তৎপরতা চলেছে বলে আগেও শোনা গেছে এবং তার সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের কারও কারও সম্পৃক্ততা রয়েছে বলেও জনপরিসরে আলোচনা আছে এবং তা অব্যাহত আছে। কোনো কোনো রাজনীতিকের কাছ থেকেও পরোক্ষভাবে এই অভিযোগ শোনা গেছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যথেষ্ট ঘোলাটে বলেই অনেকের বিশ্বাস।

এর মধ্যে আবার ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ সাতটি রাজনৈতিক দলের যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি। আগামী নির্বাচন ও রাজনীতিকেন্দ্রিক পাঁচ দফা দাবিতে এই দলগুলো শুরু করেছে আন্দোলন। পাঁচ দফা বলা হলেও তাদের প্রধান দাবি আসলে দুটি। এক. সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রদান বা বাস্তবায়ন এবং সেই সনদের ভিত্তিতে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে (পিআর) ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং দুই. ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের সহচর বা সহযোগী জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা, যেমন নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম। ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জাগপা প্রভৃতি দল এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে।

এই সাত দলের প্রধান প্রধান দাবির সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টিরও (এনসিপি) একাত্মতা রয়েছে। অর্থাৎ তাদের দাবিও প্রায় অভিন্ন। তবে তারা সংসদের উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতি সমর্থন করে না। আর সংবিধানের আমূল সংস্কার কিংবা নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য তারা গণভোট চায়। তা সত্ত্বেও কথা ছিল এনসিপি সাত দলের এই আন্দোলনের অংশ হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা জামায়াত কিংবা কোনো ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার অবস্থান থেকে সরে এসেছে। এর পরিবর্তে এনসিপি মধ্যপন্থীদের সমন্বয়ে নতুন একটি ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে। গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টি এবং আপ বাংলাদেশ নামের দলগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে তাদের আলোচনা চলেছে। এনসিপির এই অবস্থানের পেছনে অন্তর্বর্তী সরকারের দুই ছাত্র উপদেষ্টার ভূমিকা রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তো নিজের ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ধর্মভিত্তিক দলের বিরোধিতা করেছেন। এর বাইরে এনসিপি মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য এবং জোনায়েদ সাকির নেতৃত্বাধীন গণসংহতি আন্দোলনের সঙ্গেও ঐক্যের বিষয়ে আলোচনা করছে বলে জানা যায়। তবে মান্না কিংবা সাকি এনসিপির আহ্বানে ইতিবাচক সাড়া দেননি। তাঁরা বরং এনপিসিকে আহ্বান জানিয়েছেন তাঁদের গণতন্ত্র মঞ্চ জোটে যোগ দেওয়ার জন্য।

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ স্বাভাবিক বিষয়। নতুন জোট গঠন, বিদ্যমান জোটের সম্প্রসারণ বা সংকোচন—এসবই এই নতুন মেরুকরণের অংশ। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, সরকার-সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হওয়ার যে আলামত দেখেন এবং তার যে পরিণতির কথা বলেন, তা নিশ্চিত কোনো অশুভ সংকেত। তার পাশাপাশি জামায়াতসহ সাত দল তিন দিনের বিক্ষোভ কর্মসূচির মাধ্যমে যে আন্দোলন শুরু করেছে, তা-ও কোনো শুভ লক্ষণ বলে মনে হয় না। তাদের এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে শেষ হয়, তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

ছাত্র সংসদের কাজ গুন্ডামি করা নয়

ঘটনার ঘনঘটা নিয়ে বিদায় নিচ্ছে বছর

এভাবে চলতে থাকলে কি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে

প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্বের গুরুত্ব

সংকট, সম্ভাবনার সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ

গণতন্ত্রের সন্ধিক্ষণ: তারেক রহমানের দেশে ফেরা

কেন পুড়িয়ে মারার মধ্যযুগীয় বর্বরতা

তারেকের প্রত্যাবর্তন: রাজনৈতিক ভবিষ্যতের এক মাহেন্দ্রক্ষণ

বিশ্বজুড়েই কেন গণমাধ্যম আক্রান্ত

সাইবার যুদ্ধ ও নজরদারি প্রযুক্তি: বৈশ্বিক নিরাপত্তা কোন পথে