হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

সমাজে ভিন্নমতের সহাবস্থান জরুরি

মালিহা মেহনাজ

আজকের বিশ্বে একটি দেশের ধর্ম, সম্প্রদায় ও ভাষার মধ্যে বৈচিত্র্য গণতান্ত্রিকতার সৌন্দর্য হলেও, এটি প্রায়ই সংঘাতের জন্ম দেয়। ‘আমরা বনাম তারা’ মানসিকতা মানুষের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে, যা সমাজকে বিভাজনের দিকে নিয়ে যায়। প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যায় সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষেরা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর আধিপত্য এবং নিজ স্বার্থে তাদেরকে কোণঠাসা করে রাখতে চায়। ফলে একসময় তা দ্বন্দ্বের পথ ধরে সংঘাতের দিকে চলে যায়। এতে সমাজের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। সমাজে সীমিত সম্পদ ও সুযোগ থাকলে এক গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। কখনো কখনো ধর্ম, ভাষা বা রীতিনীতি ভিন্ন হওয়ায় বোঝাপড়ার অভাব দেখা দেয়, যা মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতা বাড়িয়ে তোলে। রাজনৈতিক নেতৃত্বও বিভাজনকে শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে। এসব কারণেই সমাজে জন্ম নেয় অবিশ্বাস, বিভাজন ও ক্ষোভ।

ভিন্নমত এবং ধর্ম-সম্প্রদায় ও ভাষাবৈচিত্র্য একটি সুস্থ সমাজের লক্ষণ। এটি বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার কথা থাকলেও তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে এটি প্রস্ফুটিত হতে দেখা যায় না। ফলে ভিন্নমতকে আক্রমণ বা বৈষম্যের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তখন তা সমাজের স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক সময় মতের বিরোধ ব্যক্তিগত আক্রমণে পরিণত হয়। মানুষ ভয় এবং অবিশ্বাসের মধ্যে বাস করতে শুরু করে, যা সমাজের অভ্যন্তরীণ সম্পর্ককে নষ্ট করতে সাহায্য করে। ইতিহাসে গোষ্ঠীগত সংঘাতের উদাহরণ বহুবার দেখা গেছে। প্রাচীন সভ্যতা থেকে শুরু করে আধুনিক রাষ্ট্র পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা সামাজিক মতভেদ সংঘাতের জন্ম দিয়েছে। কোনো সমাজ তখনই স্থিতিশীল থাকে, যখন ভিন্নমতকে গ্রহণযোগ্যভাবে সমাধান করা হয়। ইউরোপের ধর্মীয় যুদ্ধ, ভারতীয় উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব কিংবা আফ্রিকার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংঘাতগুলো দেখায় সামাজিক ঐক্য বজায় রাখার জন্য যথাযথ নীতি এবং সমঝোতা কতটা প্রয়োজনীয়।

গোষ্ঠীগত সংঘাতের প্রভাব বহুমাত্রিক। সামাজিক ক্ষেত্রে, পারস্পরিক অসহিষ্ণুতা, ভয় এবং বিদ্বেষ বৃদ্ধি পায়। রাজনৈতিকভাবে, সংঘাতের কারণে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ভেঙে পড়ে এবং মানুষের আস্থা কমে যায়। ব্যক্তিগত ও সাম্প্রদায়িক স্তরে অবিশ্বাস ও হতাশা জন্মে। এগুলো শুধু বর্তমানকে না, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও প্রভাবিত করে। তবে সবকিছু নেতিবাচক নয়। ভিন্নমত থাকা সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব যদি আমরা সক্রিয়ভাবে সংলাপ এবং সহমর্মিতা বজায় রাখি। সংলাপ মানে শুধু কথোপকথন নয়, এটি বোঝাপড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। ভিন্নমতকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে এটি অপরিহার্য। তাই ভিন্নমতকে আক্রমণ বা দ্বন্দ্বের হাতিয়ার নয়; বরং সম্ভাবনার অংশ হিসেবে গ্রহণ করা উচিত।

গোষ্ঠীগত সংঘাতের কারণে মানুষ প্রায়ই ভয় এবং অবিশ্বাসের মধ্যে আটকে যায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মতবিরোধ ব্যক্তিগত আক্রমণে পরিণত হয়। যে সমাজ ভিন্নমতকে গ্রহণযোগ্যভাবে সমাধান করতে পারে, সে সমাজই দীর্ঘ মেয়াদে স্থিতিশীল থাকে।

সমাজের স্থিতিশীলতা এবং শান্তি অর্জন সম্ভব, যদি আমরা ভিন্নমতকে বাধা নয়; বরং শক্তি হিসেবে দেখি। গোষ্ঠীগত বিভাজন কেবল সমস্যার সৃষ্টি করে না, এটি আমাদের সমঝোতা, সহমর্মিতা এবং সংলাপের গুরুত্ব শেখায়। একত্রে থাকা এবং ভিন্নমতকে গ্রহণ করা একটি শক্তিশালী সমাজ গঠনের গুরুত্বপূর্ণ উপায়। আজকের বিশ্বে বৈচিত্র্য এবং ভিন্নমতের সমন্বয় একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এটি আমাদের শেখায় শান্তি অর্জন কেবল বাহ্যিক নয়, অভ্যন্তরীণ। আমাদের মানসিকতা, সামাজিক সম্পর্ক এবং পারস্পরিক বোঝাপড়াই নির্ধারণ করে একটি সমাজ কতটা সমৃদ্ধ এবং স্থিতিশীল। সমাজ যখন ভিন্নমতকে গ্রহণ করে, তখনই সৃষ্টি হয় নতুন ধারণার, উদ্ভাবন হয় সমাধানের পথ।

এভাবেই সমাজে সত্যিকারের শান্তি এবং সমৃদ্ধি আসবে। সমাজের মধ্যে ভিন্নমত থাকা স্বাভাবিক; কিন্তু তা যেন দ্বন্দ্বে পরিণত না হয়, সে ব্যবস্থা করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভিন্নমত এবং গোষ্ঠীগত সংঘাত সমাজের জন্য চ্যালেঞ্জ হলেও এটি অতিক্রম করা সম্ভব। শিক্ষিত, সচেতন এবং সংলাপমুখী সমাজ স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আমরা যদি ভিন্নমতকে বাধা হিসেবে না দেখে সম্ভাবনার অংশ হিসেবে দেখি, তবেই একত্রে থাকা, সমঝোতা এবং শান্তি অর্জন সম্ভব।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

এবার নির্বাচনের দিকে চোখ থাকবে সবার

আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাস ভোক্তার কাছে পৌঁছায় না কেন

ভারতজুড়েই কি ফুটবে পদ্মফুল

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

সমুদ্রস্তরের উত্থান ও দ্বীপরাষ্ট্রের নিরাপত্তা

সংকটেও ভালো থাকুক বাংলাদেশ

মন্ত্রীদের বেতন-ভাতা নিয়ে কথা

পাঠকের লেখা: বিজয় অর্জনের গৌরব

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের কি বিচ্ছেদ হলো

একাত্তরে সামষ্টিক মুক্তি আসেনি