সাক্ষাৎকার

ঐকমত্যের প্রশ্নে অনিশ্চয়তা রয়েছে

ড. নজরুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ। মস্কো রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। জাতিসংঘে ঊর্ধ্বতন অর্থনীতিবিদ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। নানা বিষয়ে বেশ কিছু বই লিখেছেন। সম্প্রতি দেশে বেড়াতে এলে তাঁর সঙ্গে জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা

আপনি তো অনেক দিন পর দেশে এলেন। এর মধ্যে দেশে একটা গণ-অভ্যুত্থান হয়ে গেছে। বর্তমান সময় নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

প্রথমত, একটা বড় পরিবর্তন ঘটেছে। যেসব শিক্ষার্থী-জনতার মাধ্যমে এটা হয়েছে, তাদের আমি শ্রদ্ধা জানাই। এই পরিবর্তনের ফলে একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে নতুনভাবে চিন্তা করার। আমি বলব এটা হলো এই অভ্যুত্থানের বড় একটা সুফল। আর এই ঘটনার পর দেশে এসে দেখতে পাচ্ছি, এটা নিয়ে অনেক ধরনের আলোচনা হচ্ছে। সরকার অনেকগুলো সংস্কার কমিশন করেছে। এর প্রভাবে দেশের বাইরে বাঙালি প্রবাসীদের উদ্যোগে নতুন সংগঠন হচ্ছে। অনেক ধরনের বিষয় নিয়ে সভা, সেমিনার, আলোচনা হচ্ছে। এই উদ্যোগগুলো ভালো।

এ ধরনের আলোচনা গত সরকারের আমলের, বিশেষ করে শেষের দিকে করার সুযোগ ছিল না। এসব আলোচনা যদি ফলপ্রসূ হয়, তাহলে আশা করা যায় ভালো কিছু হতে পারে। আর এখন দেশের বাস্তব গতিমুখটা ইতিবাচক দিকে অগ্রসর হওয়াটাই জরুরি কাজ।

গত সরকারের সময় থেকে রিজার্ভ কমে যাচ্ছিল। এটা এখনো চলমান। অন্তর্বর্তী সরকার ছয় মাসেও সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এর কারণ কী?

আমি যে নিবিড়ভাবে সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছি, ব্যাপারটি সে রকম নয়। কিন্তু আমি তো শুনতে পাচ্ছি, ৫ আগস্টের আগের অবস্থা থেকে এখন রেমিট্যান্স আসাটা বেড়েছে। আবার সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, রপ্তানি আয়ও বেড়েছে। কাজেই রপ্তানি আয় যদি বাড়ে, তাহলে রিজার্ভের ক্ষেত্রেও একটা প্রভাব পড়ার কথা। তবে সেই জায়গা থেকে রিজার্ভের গতি-প্রকৃতিটা নিম্নমুখী কি না, সেটা আমার জানা নেই। রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয় বাড়লে তো পরিস্থিতিটা আগের অবস্থার চেয়ে উন্নত হওয়ার কথা।

বর্তমানে মুদ্রাস্ফীতি ডাবল ডিজিটে পৌঁছেছে। কারণ কী?

মুদ্রাস্ফীতি বাড়ার কারণ হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার তো বলেছে তারা ২২ হাজার কোটি টাকার নোট ছেপেছে। তার মানে সরকার নিজ উদ্যোগে বাজারে আরও বেশি টাকা ছেড়েছে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে। নতুন করে টাকা ছাড়ার পর সেই তুলনায় যদি উৎপাদন না বাড়ে, তাহলে তো জিনিসপত্রের দাম বাড়বেই। এটা একটা সাধারণ কারণ। আর নির্দিষ্ট কারণ হলো, সরবরাহ চেইন ঠিকমতো কাজ করছে না, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য আছে এবং বাজার মনিটরিংয়েও গাফিলতি আছে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারকে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সেসব উদ্যোগ গ্রহণ করলেই তবে বাধাগুলো দূর হতে পারে।

এ সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বিদেশি বিনিয়োগে বড় ধরনের ধস নামার কারণ কী?

এটা তো অবশ্যই একটা উদ্বেগের ব্যাপার। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির জন্য অবশ্যই বিনিয়োগ লাগবে। গণ-অভ্যুত্থানের পরে যে রাজনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে, তার তো একটা অর্থনৈতিক দিক থাকতে হবে। আবার অনেক রাজনীতিবিদ শিল্প-কলকারখানার মালিক। আমরা জানি, বেক্সিমকোর ২৬টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। অন্য ক্ষেত্রেও কিছু কারখানা বন্ধ হয়েছে। কারখানা বন্ধ হলে উৎপাদন কমে যায়। সেটা স্বাভাবিক ব্যাপার। ফলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও অনিশ্চয়তা দেখা দিচ্ছে। আর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এই পরিস্থিতিতে আসতে চাইবেন না। যতক্ষণ পর্যন্ত দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হবেন না। আবার দেশীয় বিনিয়োগকারীরা রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, সেটা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। সে কারণে তাঁরাও আস্থা পাচ্ছেন না। তবে এ পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা জরুরি।

বিনিয়োগ না আসাটা কি নির্বাচিত সরকার না থাকার সমস্যা?

আমাদের দেশের রাজনৈতিক বিষয়টা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। এই সরকার কত দিনের জন্য ক্ষমতায় থাকবে, সেটা কিন্তু তারা এখনো নিশ্চিত করেনি। এই প্রশ্নগুলোর তো কোনো উত্তর নেই আমাদের কাছে। নির্বাচনের মাধ্যমে কোনো দল ক্ষমতায় বসলে একটা নিশ্চয়তা পাওয়া যেত। সেখান থেকে একটা অধিকতর স্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। বিনিয়োগকারীরা হয়তো সে পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করছেন। তাঁরা বিবেচনা করছেন রাজনৈতিক পরিস্থিতিটা কোন দিকে মোড় নেয়, সেটা দেখার। একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে বিনিয়োগের অনিশ্চয়তাটা কাটতে পারে।

অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়ে আপনি কতটুকু আশাবাদী?

আমি সংস্কার কমিশন নিয়ে সে রকম আশাবাদী না হলেও কিছু সংস্কার প্রস্তাব আমার কাছে ইতিবাচক মনে হয়েছে। এই সংস্কার কমিশনের মাধ্যমে কিছু বিষয় নিয়ে যে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে, আমি এটাকে ইতিবাচক বলছি। প্রতিটা কমিশনে সাত-আটজন করে দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক আছেন। তাঁরা বিভিন্ন সেক্টরের সমস্যাগুলো ধরে জরিপের মাধ্যমে পর্যালোচনা করে রিপোর্ট দিয়েছেন। এখন কথা হলো, সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলো কতটুকু গৃহীত হবে? হলেও সেসবের কতটুকু বাস্তবায়িত হবে— সেই বিষয়গুলো এখনো নিশ্চিত না। জনগণের ভাবনার বিষয়গুলো যদি সংস্কার প্রস্তাবে আসে, এবং তারা কীভাবে সমাধান চায়, সেটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলো নিয়ে একটা ঐকমত্যের কমিশন গঠন করা হবে। সেটা অবশ্য গঠিত হয়েছে। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসে মতামতের ভিত্তিতে ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করবে। তবে সেই প্রক্রিয়াটার ফলাফল কী দাঁড়াবে, সেটা তো এখনই বলার সুযোগ নেই। কোন কোন বিষয়ে সবাই ঐকমত্যে পৌঁছাবে, সেটা তো এত সহজ ব্যাপার না। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক ধারা। তাদের মত এবং পথও আলাদা আলাদা, তাদের স্বার্থও ভিন্নমুখী। ফলে ঐকমত্য কতটুকু প্রতিষ্ঠিত করা যাবে, সেটার অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।

আর যে বিষয়গুলোতে সবার ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে, সেগুলোর বাস্তবায়ন নির্বাচনের আগে কতটুকু আর নির্বাচনের পরে কতটুকু হবে এবং নির্বাচনটা কীভাবে হবে—এর সবই এখনো অনিশ্চিত।

অন্তর্বর্তী সরকার ছয় মাস পেরোলেও বাণিজ্য উপদেষ্টা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম না কমার দায় সিন্ডিকেটের ওপর চাপাচ্ছেন। সিন্ডিকেট কেন ভাঙা সম্ভব হচ্ছে না?

ব্যাপারটি অবশ্যই হতাশার। মূলত রাজনৈতিক কারণে সিন্ডিকেটের লোকদের আঘাত করা যায় না। কিন্তু বর্তমান সরকার তো অরাজনৈতিক। কাজেই তাদের এ বিষয়ে কাজ করার বেশি সুযোগ থাকার কথা। সেটা কেন তারা করতে পারছে না, এটা একটা হতাশার ব্যাপার। শীত মৌসুম থাকার কারণে এবং সরবরাহ বাড়ার কারণে কিছু শাকসবজির দাম এখন কম। কিন্তু শীত চলে গেলে তো আবার শাকসবজির দাম বাড়তে পারে।

কিছু বিষয় আমার কাছেও স্পষ্ট নয়। যেমন কিছুদিনের জন্য টিসিবির কার্ড বাতিল করে দেওয়া হলো। বিকল্প ব্যবস্থা না করে কেন হাজার হাজার কার্ড বাতিল করা হলো। এভাবে কার্ড বাতিল করার কারণে অনেক মানুষ সমস্যার মধ্যে পড়েছে। এগুলো কেন সমন্বিত ভাবনার মাধ্যমে হচ্ছে না, সেসব আমি বুঝতে পারছি না।

আইএমএফের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী এ সরকারও সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তাহলে স্বাধীনতার ৫৩ বছর ধরে যারা ক্ষমতায় ছিল, তাদের সঙ্গে এদের পার্থক্য কোথায়?

অনেকে সাম্প্রতিক পরিবর্তনটাকে বিপ্লব বলেছেন। কিন্তু জুলাই আন্দোলনের ফলে যে সরকার গঠিত হয়েছে, তাদের কাজকর্ম বলে দিচ্ছে এটা আসলে কোনো বিপ্লব না। বিগত সরকারগুলোর শ্রেণির জায়গা, তাদের আর্থসামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণের সঙ্গে এ সরকারের বিভিন্ন ভাবনার জায়গাগুলো দেখলে বোঝা যায়, এখানে কোনো গুণগত পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে না। সে জায়গা থেকে দেখা যাচ্ছে, শেখ হাসিনার সরকার আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া শুরু করেছিল, সেই প্রক্রিয়াটা এ সরকারের আমলেও চলছে। সেই ধারাবাহিকতায় আইএমএফ যেসব শর্ত দেয় এবং এই সরকারও সেই শর্তগুলো পূরণ করার চেষ্টা করছে। যেমন বড় শর্ত হলো, কর বা ভ্যাটের বোঝা বাড়ানো। এ কারণে সরকার প্রায় ১০০টি পণ্যের ওপর কর বৃদ্ধি করল। কিন্তু কর বাড়ানো তো কোনো গণমুখী পদক্ষেপ না।

অন্যদিকে প্রত্যক্ষ কর আদায় করা একটা কঠিন কাজ। এই প্রত্যক্ষ কর যাঁদের ওপর আরোপিত হবে, তাঁরা অবশ্যই ধনী ব্যক্তি হবেন এবং তাঁদের রাজনৈতিক প্রভাবও বেশি। সে কারণে অন্তর্বর্তী সরকার প্রত্যক্ষ কর আদায়ে সাহস দেখাতে পারল না।

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের যে পরিবর্তনের প্রত্যাশা ছিল, সে আশা কিন্তু নিরাশায় পরিণত হচ্ছে। কিন্তু কথা হলো, সেই নিরাশাকে কীভাবে আশায় পরিণত করা যাবে?

এই সরকার দু-একটি ক্ষেত্রে কিছু সফলতা দেখাতে পেরেছে। যেমন ব্যাংকিং খাতকে একটি জায়গায় দাঁড় করাতে পেরেছে। দেউলিয়া হওয়া থেকে কিছু ব্যাংককে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। আগে যেমন সবটাই বেসামাল হয়ে গিয়েছিল। বিগত সরকার তাদের শেষ দিকে কোনোভাবেই কোনো কিছু সম্পন্ন করতে পারছিল না। সবকিছুই ‘আউট অব কন্ট্রোল’ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। সেই জায়গায় মনে হয় বর্তমান সরকার আগের তুলনায় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা সফল হয়েছে। কিন্তু বৃহৎ অর্থে তারা সে রকম পরিবর্তন করতে পারেনি। সে কারণে জনগণের মধ্যে আশাভঙ্গের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তারা যে নতুনভাবে অনেক কিছু পরিবর্তন করতে পারবে, সে সম্ভাবনা আমি দেখতে পাচ্ছি না।

সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

আপনাকেও ধন্যবাদ।

এবার নির্বাচনের দিকে চোখ থাকবে সবার

আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাস ভোক্তার কাছে পৌঁছায় না কেন

ভারতজুড়েই কি ফুটবে পদ্মফুল

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

সমুদ্রস্তরের উত্থান ও দ্বীপরাষ্ট্রের নিরাপত্তা

সংকটেও ভালো থাকুক বাংলাদেশ

মন্ত্রীদের বেতন-ভাতা নিয়ে কথা

পাঠকের লেখা: বিজয় অর্জনের গৌরব

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের কি বিচ্ছেদ হলো

একাত্তরে সামষ্টিক মুক্তি আসেনি