হাসান আজিজুল হক প্রয়াত হয়েছেন খুব বেশি দিন আগের ঘটনা নয়। কিন্তু এরই মধ্যে টের পাওয়া যায় যে তাঁকে নিয়ে পাঠকদের, বিশেষভাবে তরুণ পাঠকদের আগ্রহের টানে বেশ খানিকটা ভাটা পড়েছে। কারণগুলো খুব যে অযৌক্তিক, সেটা বলাও আমাদের উদ্দেশ্য নয়। সবকিছু মেনে নিয়েও লেখক হাসান আজিজুল হকের শৈল্পিক সামর্থ্যের দিকটিকে তো আমরা কোনোভাবেই উপেক্ষা করতে পারি না। বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাস হাসান আজিজুল হকদের বাদ দিয়ে লেখা সম্ভব নয়, সে চেষ্টা যেন কখনো আমাদের না করতে হয়! কেননা, আমাদের সেই হাসান, যিনি তাঁর লেখক-জীবনের একেবারে শুরু থেকে এমন কোনো মুহূর্ত যায়নি যখন তিনি দেশের সর্বজনকে নিয়ে ভাবেননি, তাদের দুঃখ-দুর্দশায় বিচলিত বোধ করেননি।
২.
সাহিত্যের জগতে লেখকদের প্রবল প্রতাপের পাশাপাশি তাঁদের প্রস্তুতির নানা কথাও আমরা শুনতে পাই। হাসান আজিজুল হকের সাহিত্য-পরিক্রমায় যেকোনো নিবিষ্ট পাঠকই এটি উপলব্ধি করতে পারবেন যে, আমাদের সাহিত্যে এতটা প্রস্তুতি নিয়ে হাসানের মতো খুব বেশি লেখক আসেননি। অনেকেরই কাছে এটি নিছক আবেগে ভর দিয়ে বলা কথা মনে হতে পারে। কিন্তু দার্শনিক রুশো প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সরদার ফজলুল করিম আমাদের জানিয়েছেন, ‘মানুষের আবেগকে যুক্তি দিয়ে সব সময় বোঝা যায় না। আবেগকে বুঝতে আবেগের গভীরে যেতে হয়।’ হাসানের শৈল্পিক সামর্থ্যের কথা আমরা বলেছি। কী বোঝায় এই কথা দিয়ে? একজন লেখকের শৈল্পিক সামর্থ্য বিচারের মাপকাঠিইবা কী? চেখভ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছিলেন, এই লেখক সারা জীবন একধরনের সংগ্রাম করে গেলেন। কিসের সংগ্রাম? শৈল্পিক জীবনযাপনের জন্য সংগ্রাম।
হাসানের সংগ্রাম ঠিক সেই শিল্পিত জীবনের পক্ষে আর কদর্যতার বিরুদ্ধেই। সাধারণ মানুষের জীবন-ধারণ, তাদের সংগ্রামের পরাজয়, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, হতাশা—এসব নিয়েই হাসানের সাহিত্যের জগৎ নির্মিত হয়েছে। প্রবলভাবে রাজনীতিসচেতন ছিলেন হাসান, তিনি একই সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক সত্তাকে সার্থকভাবে মিলিয়ে দিতে পারতেন তাঁর শৈল্পিক সত্তার সঙ্গে। জীবনের এই দিকটাতে হাসান কখনোই আপস করেননি। করেননি তার অন্যতম কারণ হচ্ছে এই যে, হাসান চেতনার গভীর থেকেই মনে করতেন, শিল্পের প্রধান কাজ হচ্ছে পাঠকগোষ্ঠীকে নানাভাবে ‘প্রভাবিত করা, আঘাত করা’ এবং ‘কোনো সমগ্রতায়’ পাঠককে পৌঁছে দেওয়া। এর পাশাপাশি তাকে শৈল্পিক ‘সত্যের বিচ্ছুরণ দেখিয়ে দেওয়া’। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, ‘শিল্পকলা শিল্পিতকে ডিঙিয়ে আপনার স্বাতন্ত্র্যকেই মুখ্য করে তোলে। কেননা, তার মধ্যেও আছে সৃষ্টির প্রেরণা।’ সেইসব উপলব্ধিকে হাসান কখনোই অস্বীকার করেননি।
৩.
বুদ্ধদেব বসু তাঁর একটি প্রবন্ধে অকপটে স্বীকার করেছিলেন, ‘যৌবনে...মানুষের যত রকম অবস্থা আছে, তার মধ্যে নিঃসঙ্গতাকেই তখন সবচেয়ে বেশি ভয় পেতুম।’ তাঁর মতে, ‘শুধু সঙ্গীহীনতাকেই নিঃসঙ্গতা বলে না, মনকে নিবিষ্ট করার উপায়ের অভাবকেই বলে নিঃসঙ্গতা।’ হাসান আজিজুল হকও আরও অনেকেরই মতো এই নিঃসঙ্গতাকে সম্ভবত ভয় পেতেন। সব সময়ই জনমানুষের মধ্যে থাকতে চাইতেন। এইভাবেই হয়তো জীবনের উত্তাপ সংগ্রহ করে নিতেন, গুরুত্ব দিয়েছিলেন সমকালকেও। কেননা, তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে হাসানের মনে হয়েছে, ‘সমকালের জন্যে কোনো মায়া বা স্বপ্ন রচনা করা কথাসাহিত্যের একটা কাজ হতে পারে। তবে দূর অতীত কিংবা দূর ভবিষ্যৎকে নিয়ে স্বপ্ন তৈরি করা যতটা সহজ, বর্তমানকে নিয়ে ততটা নয়। কারণ, বর্তমান তিক্ত এবং সাধারণত বর্ণহীন।’ সেই তিক্ত এবং বর্ণহীন বর্তমানের ওপর ভর দিয়েই হাসান তাঁর কথাসাহিত্যের জগৎটাকে নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। নিশ্চিতভাবেই একটানা পরিশ্রম এবং কষ্টের কাজ ছিল এটি; কিন্তু সাহিত্যিকের কর্তব্য তো সেই কঠিনকেই শিল্পের অবয়ব দেওয়া, যা হাসানের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। এখানেই হাসান আজিজুল হকের সামর্থ্যের চিহ্ন, যা কোনোভাবেই অস্বীকার করবার উপায় থাকে না। তাঁর ‘সাক্ষাৎকার’ গল্পের শেষাংশে এসে চরিত্রের স্বগতোক্তি আমাদের পাঠ করতে হয়—‘মানুষ যে সামাজিক, সে নিজের ইতিহাস জানিতে চাহিয়াছে, তাহাতে সর্বদাই অন্ধকার নর্তনকুর্দন করিতেছে। তবু আমি মানুষের কাছে প্রার্থনা জানাইব—কারণ মানুষেই মানুষের গা ঘেঁসিয়া থাকে—যদিও ঐ দেখা যায় না।’ এখানেই কথাগুলো শেষ হতে পারত, কিন্তু হয় না।
আইনস্টাইন শুধুই একজন বিজ্ঞানী হিসেবে নয়, সেই সঙ্গে একজন মানুষ হিসেবেও ‘ইতিহাসের অভিজ্ঞতা, সৌন্দর্য এবং ঐক্যের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে যেসব আদর্শের জন্ম হয়েছে’, তাতে আস্থা রাখতেন। লেখক হিসেবে হাসান আজিজুল হককে সেই আস্থায় পরিণত হতে দেখতে পাওয়া যায়। যে কারণে তাঁর ওই গল্পের চরিত্র একদম শেষ বাক্যে এসে বলেছিলেন, ‘কোথাও কিছু পাই নাই বলিয়াই বাধ্য হইয়া আমি শেষ পর্যন্ত মানুষের কাছেই আবেদন জানাইব। ইতিমধ্যে সবকিছু চমৎকার ঘটিয়াছে। অবশ্য অনেক কিছুই বাকিও রহিয়া গেল কারণ কিছুই শেষ হইবার নহে।’ একজন লেখক তাঁর কাহিনির নবায়নে শিল্পিত ব্যাপ্তিতে কতটা দক্ষ হয়ে উঠতে পারেন, সেটি হাসান আজিজুল হক আমাদের দেখিয়ে দিলেন! তাঁর কথাসাহিত্যের মানুষদের তিনি সব সময়ই এই মর্যাদাবোধে, সহিষ্ণুতায়, ভালোবাসায় আমৃত্যু অভিসিঞ্চিত করে গিয়েছেন। ১৫ নভেম্বর হাসান আজিজুল হকের প্রয়াণ দিবস। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা।