হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

শ্রদ্ধাঞ্জলি: মীরা দেববর্মন

আবদুল্লাহ আল মোহন

মীরা দেববর্মন (জন্ম: মার্চ ১৯২৩, মৃত্যু: ১৫ অক্টোবর ২০০৭)

মীরা দেববর্মন ছিলেন বাংলা গানের এক অসামান্য গীতিকার, যিনি কৃতী স্বামী এবং সন্তানের নামের আড়ালে ছড়িয়ে গিয়ে জড়িয়ে আছেন আপন সৃষ্টির কারণেই। অনেকের হয়তো জানা নেই, আধুনিক বাংলা গানের কিংবদন্তি প্রয়াত শচীন দেববর্মনের স্ত্রী এবং উপমহাদেশের আরেক কিংবদন্তি সুরকার রাহুল দেববর্মনের মাতা মীরা দেববর্মন অসংখ্য জনপ্রিয় গানের একজন নিভৃতচারিণী গীতিকার। মীরা দেববর্মন রচিত, শচীন দেববর্মনের সুরে ও কণ্ঠে সুপরিচিত কয়েকটি গান হলো ‘বিরহ বড় ভালো লাগে’, ‘গানের কলি সুরের দুরিতে’, ‘ঘাটে লাগাইয়া ডিঙা’, ‘বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে’, ‘কালসাপ দংশে আমায়’, ‘কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া’, ‘কী করি আমি কী করি’, ‘না আমারে শশী চেয় না’, ‘নিটোল পায়ে রিনিক ঝিনিক’, ‘শোন গো দখিন হাওয়া’, ‘তাকদুম তাকদুম বাজাই’ ইত্যাদি।

যিনি ছিলেন অবিভক্ত বাংলার পূর্ববঙ্গের ঢাকা জেলার এক অভিজাত পরিবারের কন্যা। মীরা দেববর্মন ১৯২৩ সালের মার্চ মাসে কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন জানা গেলেও সঠিক তারিখ উদ্ধার করা যায়নি।

একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় শচীন দেববর্মন আরব সাগরপারে থেকেও প্রতিনিয়ত খবর নিতেন, বাংলার দামাল ছেলেরা যুদ্ধে কতটা জয় হাসিল করতে পারল। ভালো খবরের জন্য উৎসুক হয়ে থাকতেন। তাঁর আত্মা তখন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম। শচীনকর্তার আবেগ ও আকুতি বুঝতে পেরেছিলেন মীরা। আর তাই ১৯৭১ সালে রেকর্ড করা হলো ‘তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল’।

১৯৩৭ সালে এলাহাবাদে অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে শচীন দেববর্মনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ও প্রেম। ১৯৩৮ সালে তাঁরা বিবাহ করেন। মীরা দেববর্মন তাঁর স্বামী ও পুত্রের সংগীতজীবনে নিরন্তর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। আর নিজেকে রেখেছেন অন্তরালে। তিনি সফল ছিলেন একাধারে গীতিকার, সংগীতশিল্পী ও নৃত্যশিল্পী হিসেবে। প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন যেমন, একই সঙ্গে যুগের তুলনায় সঠিকভাবে তালিমও পেয়েছিলেন। আর তাই সংগীতের সব ক্ষেত্রে সমান পারদর্শিতা ছিল তাঁর। নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন, সম্পূর্ণ ছিল সুরের জ্ঞান।

মীরা দেববর্মনের দাদু রায়বাহাদুর কমলনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন ঢাকা হাইকোর্টের চিফ জাস্টিস। দাদু ও দিদিমার বাড়িতে জন্ম থেকে থাকতে হয় পারিবারিক কারণে। তারপর কলকাতার সাউথ এন্ডে বসবাস শুরু করেন তাঁদের সঙ্গে। সেখানে শুরু হয় পড়াশোনার সঙ্গে সংগীতের তালিম। বিদ্যালয়ে শিক্ষা ও সংগীত শিক্ষা সমানতালে চলে। ১৯৩৭ সাল থেকে শচীন দেববর্মনের কাছে গান শিখতে শুরু করেন। এ ছাড়া তিনি সংগীতগুরু ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতের তালিম নিয়েছেন। কীর্তন ও ঠুমরি শেখেন সংগীতাচার্য ধীরেন্দ্রনাথ দেবের কাছে। ১৯৩০ সালে আনাদি দস্তিদারের কাছে রবীন্দ্রসংগীতে শিক্ষালাভ করেন এবং শান্তিনিকেতনে অমিতা সেনের কাছে নৃত্যে তালিম নিয়েছিলেন।

মীরা দেববর্মনকে নিয়ে সংগীতবোদ্ধাদের অভিমত যথার্থই মনে হয়, ‘শাস্ত্রীয় সংগীতের তুখোড় জ্ঞানসম্পন্ন গায়িকা, নৃত্যশিল্পী, রবীন্দ্রসংগীতেও সমান দক্ষতা, গানের কথাকার হিসেবে আধুনিকমনস্কতা, শব্দের ব্যবহার, মাটির কাছাকাছি থাকার প্রবণতা—অবাক হতে হয়। শচীন দেববর্মনের যে গানগুলোর সুরের আবেশে মাতাল হই এবং নিয়ত গুনগুন করি, সেগুলোর অনেক সুরই মীরা দেববর্মনের সহায়তায় তৈরি হয়েছে।’

মীরা দেববর্মন বিয়ের বছরে অল ইন্ডিয়া রেডিও, কলকাতা থেকে অডিশন দিয়ে উত্তীর্ণ হন। সেই সঙ্গে শুরু করেন পড়াশোনাও। আইএ পরীক্ষায় বসলেন। কিন্তু সংগীতের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধায় পড়াশোনায় ইতি দিয়ে সংগীতের পথ ধরেই হাঁটলেন। স্বামীর সঙ্গে বোম্বে গেলেন, নতুন অধ্যায় শুরু হলো। বোম্বেতে গিয়ে ফৈয়াজ মহম্মদ খানের কাছে তালিম নিলেন। সংগীতের পিপাসা ছিল অসীম। নিজেকে সমৃদ্ধ করার প্রয়াস চলছিল নিরন্তর। ১৯৪৫ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিও, বোম্বে থেকে অডিশন পাস করে ঠুংরি ও গজল পরিবেশন করতেন। সেই সময় তিনি দুটি নাটক শান্তি ও নয়া প্রভাতের গানের কথা রচনা করেন। অনেক গানের রেকর্ডও করেন। আবার সহকারী সংগীত পরিচালক হিসেবেও তিনি ছিলেন একজন সফল মানুষ। নয়া জমানা, তেরে মেরে স্বপ্নে, শর্মিলী, অভিমান, বারুদ, প্রেমনগর—বিখ্যাত এই চলচ্চিত্রগুলোর সহযোগী সংগীত পরিচালক ছিলেন তিনি।

১৯৭৫ সালে স্বামী এবং ১৯৯৪ সালে পুত্রের মৃত্যুর পর তাঁর জীবন জটিল হয়ে পড়ে। এই মৃত্যুশোক তাঁকে অনেকটাই মানসিক ভারসাম্যহীন করে তোলে। জীবনের শেষ দিনগুলো বেদনার হয়ে উঠেছিল এই অসামান্য গীতিকার, সুরমালিকার। কথায় কথায় মালা গেঁথেছিলেন যিনি, বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাঁর কথা। কেবল শচীন দেববর্মনের গান শুনলে নড়েচড়ে উঠতেন। চেতনার জগৎ তাঁর কাছে মূল্য হারিয়েছিল। এমন অবস্থায় ত্রিপুরা সরকার সহযোগিতার হাত বাড়ালে তাঁকে মুম্বাইয়ে স্থানান্তর করা হয়। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁকে মুম্বাইয়ে রাহুল দেববর্মনের বাড়িতে নিয়ে রাখা হয়। ওই বছরের ১৫ অক্টোবর দীর্ঘদিন রোগভোগের পর তাঁর মৃত্যু হয়।

লেখক: আবদুল্লাহ আল মোহন

সহযোগী অধ্যাপক, ভাসানটেক সরকারি কলেজ

যেখানে মুক্তিযুদ্ধ বেঁচে থাকে

মা কুকুর ও তার আটটি ছানা

যেথায় হাওয়ায় ভাসে ফুলের কান্না

মিসরের আরেকটি নামকাওয়াস্তে ভোট

ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কি থাকছে

চীন-আমিরাত সামরিক সখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভেতর-বাহির

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শিক্ষা কেন দরকার

ক্যারিয়ার নিয়ে বিভ্রান্তি

বিষ্ণু দের কাব্যচেতনার সমগ্রতা