হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

বেকার আলাপে গড্ডলিকা প্রবাহ

আমাদের দেশের পুরো কর্মকাণ্ড পাখির দৃষ্টিতে দেখলে হাস্যরসের সৃষ্টি করবে, কারণ, আমাদের দেশের মানুষের যেটা অত্যন্ত প্রয়োজন, মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার প্রাথমিক শর্তগুলো পূরণ করা, সেগুলোই আমরা এখন পর্যন্ত পূরণ করতে পারিনি।

বিধান রিবেরু

ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে রাতদিন ভিউ-ব্যবসায়ীরা বনে যাচ্ছেন ইতিহাসবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ।

বাংলাদেশে ঘটনার তো শেষ নেই! খোদ রাজধানীর ভেতরে এক মাসের ব্যবধানে তেজগাঁও ও কাকরাইলে দুটি গির্জায় ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হলো, মোহাম্মদপুরে মিশনারি বিদ্যালয় সেন্ট যোসেফ স্কুলে বোমা মারা হলো, কিন্তু এগুলোর পেছনে কারা রয়েছে, কারা হামলা চালাল, সেটার সুরাহা প্রশাসন তো করতে পারেইনি, বিষয়গুলো নিয়ে সরকারে থাকা দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তিকে উদ্বেগও প্রকাশ করতে দেখিনি। অথচ অনেক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকেই দেখি ফেসবুকে নানা বিষয়ে অনর্থক, অত্যন্ত কুরুচিকর, আজেবাজে পোস্ট দিয়ে যাচ্ছেন, যেটা তাঁদের পদ ও মর্যাদার সঙ্গে একেবারেই বেমানান। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটাই যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে কাদা ছোড়াছুড়ির সংস্কৃতি। আর সেখানে ফেসবুক ও ইউটিউব হয়ে দাঁড়িয়েছে সেসব করার ও দেখার এক উৎকৃষ্ট মঞ্চ।

কোনো রাষ্ট্রে যখন দায়িত্বশীল লোকজনের কাছ থেকে অত্যন্ত হালকা ও নিম্নস্তরের পোস্ট উৎপাদন করা হয়, তখন তার সমর্থনে কিংবা বিপক্ষে একদল মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে। অনেকে বুঝে, অনেকে না বুঝে সেসব ঠুনকো পোস্ট নিয়ে তর্কবিতর্ক জুড়ে দেয়। এটা যেন রুটি ছুড়ে দিয়ে সারমেয়দের ব্যতিব্যস্ত করে দেওয়া। রাষ্ট্রীয়ভাবে দামি লোকদের সস্তা পোস্ট নিয়ে এই যে অগভীর ও চিন্তাহীন কথাবার্তার প্লাবন শুরু হয়, এটাকে বলা যায় ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা’, অথবা জনগণের অলস মস্তিষ্ককে শয়তানের কারখানায় পরিণত করা। জার্মান দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার হলে বলতেন ‘আইডল টক’, জার্মান ভাষায় ‘গেরিদা’। তো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বেকার আলাপ ছুড়ে দিয়ে, তাতে ব্যস্ত করে দিয়ে গোটা জাতিকে যে গড্ডলে পরিণত করা হয়, সে সম্পর্কে খুব কম মানুষই অবগত। কারণ, গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিলে নিজের আর কষ্ট করে সাঁতার কাটতে হয় না। স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতার কাটতে সাহস ও প্রস্তুতি প্রয়োজন। কিন্তু অনুকূলে সাঁতার কেটে, অন্য গড্ডলদের সঙ্গে মিলেমিশে অজস্র সব আবর্জনা উৎপাদন করা সহজতর কাজ। মুশকিল হলো, এসব আবর্জনা কোন ডাস্টবিনে ফেলা হবে, সেটাই মানুষ বুঝতে পারছে না। আবর্জনার স্তূপের কারণে সজীব ও সুস্থ চারা গাছ যেমন জন্মাতে পারে না, তেমনি বেকার আলাপের তোড়ে গভীর ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চিন্তাও জন্ম নিতে পারছে না। ফলে সমাজে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সবাই অশ্বডিম্ব প্রসব করে চলেছে। কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। চিকিৎসা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা—সব নিম্নগামী হতে হতে পাতালে প্রবেশ করেছে।

আমরা প্রথমে ধীরে ধীরে একটি চিন্তাহীন, অসংবেদনশীল ও উগ্র সমাজ তৈরি করেছি। এরপর তার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার আয়োজন করে, বিদেশিদের দাওয়াত দিয়ে কাঁঠাল খাওয়াচ্ছি। মাথার ওপর যে বিরাট মেজবানি খাওয়াদাওয়া চলছে, সেটা আমরা টের পাচ্ছি না, কারণ আমরা এরই ভেতর গড্ডলে পরিণত হয়েছি। তার ওপর বিচরণক্ষেত্র হিসেবে দেওয়া হয়েছে ফেসবুক কিংবা ইউটিউবকে। সেখানে দেখবেন রাতদিন ভিউ-ব্যবসায়ীরা বনে যাচ্ছেন ইতিহাসবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ ইতি ও আদি। অবশ্য এই ভিড়ের ভেতর যে দু-একজন প্রকৃত যোগ্য লোক নেই, তা নয়। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ে দেখা যায়, ছদ্মবেশী ভিউ-ব্যবসায়ীরা উল্টাপাল্টা বেকার আলাপ করছেন এবং সেসব নিয়ে ফেসবুক গরম করে ফেলছে দেশের মানুষ।

অবশ্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম থাকাতে একটি উপকারও হয়েছে। এর মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে আসলে কারা অলস বা বেকার আলাপ পছন্দ করে, কাদের চিন্তা অস্বচ্ছ কিংবা কাদের ভাবনা কতটা নোংরা। যেমন সংখ্যালঘুদের উপাসনালয়ে হামলার কথা জানিয়ে প্রতিবাদ প্রকাশ করলে, উল্টো বলা হয়, উন্নত দেশে নাগরিকত্ব পাওয়ার ফন্দিফিকির করা হচ্ছে। এদের ভাবখানা এমন যে উন্নত দেশগুলো গন্ডায় গন্ডায় লোক নেওয়ার জন্য অধীর অপেক্ষায় বসে আছে। কেউ একজন সংখ্যালঘু কার্ড টেবিলে ফেললেই ওনারা তাদের উদ্ধার করে নিয়ে যাবে! আর সংখ্যালঘুদের এ দেশ থেকে তাড়াতে পারলে ওই বিশেষ শ্রেণি যেন বিশেষ আরাম পায়। এর পেছনে জমিজমা হাতিয়ে নেওয়ার অচেতন ভাবনা যে নেই, সেটি হলফ করে বলা যায় না।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ থেকে ধীরে ধীরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যা কমছে কেন? এই প্রশ্ন করার বদলে উল্টো বলা হয়, সংখ্যালঘুরা নাকি এ দেশকে নিজেদের দেশ মনে করে না। এ ধরনের অত্যন্ত আপত্তিকর ও কুরুচিপূর্ণ কথা সমাজে প্রচলিত আছে। এবং এসব চিন্তার খরিদ্দার শুধু অল্পশিক্ষিত মানুষ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা পর্যন্ত এসব চিন্তা পোষণ করেন এবং সেই মোতাবেক সাম্প্রদায়িক আচরণ করেন। অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতে গেলে প্রাত্যহিক চর্চার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। এই চর্চা সমাজের শিক্ষিত অংশটি শুরু করবে এবং সবার মাঝে ছড়িয়ে দেবে, সেটাই প্রত্যাশিত, কিন্তু আমরা তা হতে দেখছি না।

শুরুতে যে হামলার ঘটনার কথা বললাম, সেগুলো নিয়ে গণমাধ্যমগুলোও উদাসীন থেকেছে। তারাও একে গুরুত্ব দিতে নারাজ। গণমাধ্যমেও সংখ্যালঘুর প্রতি সামাজিক মনোভঙ্গি প্রতিফলিত। ব্যক্তিগতভাবে আমি সংখ্যালঘু ধারণায় বিশ্বাস করি না, কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্র যখন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—তুমি সংখ্যালঘু—তখন আসলে আপনি না ভেবে পারবেন না। এত যে সংবিধান সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, কোথাও তো এই বড় বড় নতুন সংবিধান বিশেষজ্ঞদের বলতে শুনলাম না, সংবিধানে কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকবে না। রাষ্ট্র কোনো ধর্মের হতে পারে না। রাষ্ট্র হবে সব ধর্ম ও সব জাতিগোষ্ঠীর মানুষের। দেশে তো জাতিগতভাবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরাও সংখ্যালঘু। তাদের ব্যাপারেও তো একই রকম অবহেলা ও অবজ্ঞা নজরে পড়ে।

একে তো ইদানীং রাস্তাঘাটে চলাচলই হয়ে পড়েছে অত্যন্ত বিপজ্জনক। পানের পিক থেকে শুরু করে নির্মাণাধীন ভবনের ইট কিংবা মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড, যেকোনো জিনিস যেকোনো সময় মানুষের মাথায় এসে পড়তে পারে এবং আপনি প্রাণ হারাতে পারেন। তার ভেতর এখন যুক্ত হচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। সকাল-বিকেল বাসে আগুন, গাড়িতে আগুন। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে ততই যেন আমরা নাগরিক নিরাপত্তা হারাতে দেখছি।

একদিকে সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তাহীনতার ভেতর আছে, অপর দিকে রাষ্ট্রীয়ভাবেও নাগরিকেরা ভীষণ রকমভাবে বঞ্চিত ও অনিরাপদ। ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে, প্রতিদিন মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ও মারা যাচ্ছে। তারপরও দেখবেন দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বেকার আলাপ করে সমাজে শুধু নিরর্থক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছেন তা নয়, প্রতিবেশী দেশকেও খেপিয়ে তুলছেন। হাইডেগার বেঁচে থাকলে এ ধরনের আলাপকে বলতেন উসকানিমূলক প্রলাপ। সরকারের দায়িত্বে থাকা মানে দেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেওয়া। কেবল তা-ই নয়, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করা এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তিকে ঊর্ধ্বে তুলে রাখা। অথচ পরিতাপের সঙ্গে আমরা লক্ষ করছি, এসব পদে বসে থাকা মানুষেরা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে একের পর এক মিথ্যাচার শুধু না, প্রলাপ বকে যাচ্ছেন। এ থেকে বোঝা যায়, হয় তাঁরা গভীর চিন্তা করতে অক্ষম, নয়তো গভীরভাবে চিন্তা করেই দেশের ভেতর ও বাইরে একধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চান। গড্ডলকে ব্যস্ত রাখাই যেন তাঁদের একমাত্র কর্তব্য। যেন গড্ডলেরা মানুষের মতো চিন্তা করতে না পারে। যেন তাঁদের ভুলত্রুটিগুলো নিয়ে মানুষ কার্যকর আলাপ করতে না পারে।

আমাদের দেশের পুরো কর্মকাণ্ড পাখির দৃষ্টিতে দেখলে হাস্যরসের সৃষ্টি করবে, কারণ, আমাদের দেশের মানুষের যেটা অত্যন্ত প্রয়োজন, মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার প্রাথমিক শর্তগুলো পূরণ করা, সেগুলোই আমরা এখন পর্যন্ত পূরণ করতে পারিনি। সরকারি হাসপাতালে উঁকি দিলেই এই কথার কিছুটা সত্যতা মিলবে। ফুটপাতের দিকে তাকালেও বোঝা যাবে ন্যূনতম নাগরিক সুযোগ-সুবিধার কতটুকু আমরা পাই। একটি দেশে যে ব্যাপক বৈষম্য, অনিয়ম ও বঞ্চনা রয়েছে, সে সম্পর্কে মানুষকে অচেতন করে রাখা যাচ্ছে, এর পেছনের কারণ একটি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তাদের গড্ডলে পরিণত করা হয়েছে। এই গড্ডলকে রাজনৈতিক ফায়দা আদায়ের জন্য শুধু ব্যবহার করা হয়। এই ব্যবহৃত গড্ডল কবে মানুষ হয়ে উঠবে, তা একমাত্র ওই গড্ডলই জানে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র গবেষক

ছাত্র সংসদের কাজ গুন্ডামি করা নয়

ঘটনার ঘনঘটা নিয়ে বিদায় নিচ্ছে বছর

এভাবে চলতে থাকলে কি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে

প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্বের গুরুত্ব

সংকট, সম্ভাবনার সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ

গণতন্ত্রের সন্ধিক্ষণ: তারেক রহমানের দেশে ফেরা

কেন পুড়িয়ে মারার মধ্যযুগীয় বর্বরতা

তারেকের প্রত্যাবর্তন: রাজনৈতিক ভবিষ্যতের এক মাহেন্দ্রক্ষণ

বিশ্বজুড়েই কেন গণমাধ্যম আক্রান্ত

সাইবার যুদ্ধ ও নজরদারি প্রযুক্তি: বৈশ্বিক নিরাপত্তা কোন পথে