হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

রাশিয়া-ইউরোপ কি বিশ্বযুদ্ধের দিকে অগ্রসর হচ্ছে

আব্দুর রাজ্জাক 

রাশিয়ার বিরুদ্ধে ডেনমার্কসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো শক্তি সঞ্চয় করার কথা ভাবছে।

সারা বিশ্বে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। গত এক মাসের ঘটনায় পশ্চিমা দেশগুলো ভীষণ রকম উদ্বিগ্ন। এই উদ্বিগ্ন হওয়ার যতগুলো কারণ আছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো রাশিয়ার ড্রোন পোল্যান্ডের আকাশসীমা অতিক্রম করেছে। স্বাভাবিকভাবে পশ্চিম ইউরোপের দেশের নেতারা মনে করছেন, এটা রাশিয়ার একটি মহড়া। রাশিয়া কোনোভাবেই শুধু ইউক্রেন দখল করে ক্ষান্ত হবে না, আরও পশ্চিম দিকে তারা হাত বাড়াতে পারে। তাই তৎপরতা বাড়িয়ে দিচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব। রাশিয়ার বর্তমান কার্যক্রমের ব্যাপারে সবচেয়ে সোচ্চার ব্যক্তি হলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ। মাখোঁ যে মন্তব্য করেছেন, সেটা খুবই ভয়াবহ। তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, এক ভীষণ দখলদার গোটা ইউরোপকে গিলে খেতে চলেছে।

মাখোঁ শুধু পুতিনের ওপর বিষোদগার করে ক্ষান্ত হননি, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে দেশের কী করণীয়, তার ওপর বিশেষ নজর এবং নির্দেশনাও দিয়েছেন, কী কী করতে হবে। মাখোঁ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে বলে দিয়েছেন যুদ্ধকালে হতাহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা আগে থেকে করে রাখতে। হাসপাতালে বাড়তি সিট, ক্লিনিকগুলোকে তৎপর রাখাসহ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে যে ধরনের সেবা দিতে হয়, সে ব্যাপারে অ্যালার্ট করেছেন। এই তৎপরতার অর্থ দাঁড়ায়, ফ্রান্স ইউক্রেনের পক্ষ হয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। রাশিয়া পরাজিত হওয়ার দেশ নয়, তাই তারাও তাদের নিজেদের ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে সতর্ক হয়েছে।

সম্প্রতি কোপেনহেগেনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা সভার পরে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী বলেই ফেলেছেন, ‘শান্তির জন্য যদি দরকার হয় আমরা শক্তি প্রয়োগ করব। অর্থাৎ, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ডেনমার্কসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো শক্তি সঞ্চয় করার কথা ভাবছে। এখন ইউরোপিয়ান দেশগুলো যদি রাশিয়ার বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন করে, সেটা শান্তির পরিবর্তে অশান্তিই ডেকে আনবে। ন্যাটো সদস্যভুক্ত দেশগুলোর সামরিক শক্তি আমেরিকাকে বাদ দিয়ে, রাশিয়ার চেয়ে কম। তাই তারা এখন উঠেপড়ে লেগেছে রাশিয়ার থেকে শক্তি সামর্থ্যে অগ্রসর হতে।

পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর মাথাব্যথার কারণ হলো, রাশিয়া যদি সত্যি সত্যি ইউক্রেন দখল করে নেয়, পরবর্তী সময়ে তাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কীভাবে ঢেলে সাজাবে? সেই জন্যই ইউরোপিয়ান দেশগুলো চাইছে রাশিয়া যেন ইউরোপকে দখল করতে না পারে, রাশিয়া যেখানে আছে সেখানেই তাকে স্টপ করে দেওয়া। তাই আপাতত ন্যাটো ইউক্রেনকে সব দিক থেকে সাহায্য করছে।

ইউক্রেনের ভেতরে নানা অনিয়ম চলছে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। ভলোদিমির জেলেনস্কি ইউরোপিয়ান মিত্রদের কাছে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর মানসিক ও সার্বিক অবস্থা, অর্থনীতির সঠিক চিত্র তুলে ধরছেন না। ইউক্রেনের আর্মির মধ্যে বিভাজন চলছে। ইউক্রেনের একজন সামরিক বিশেষজ্ঞ মিস্টার বজকো বলেছেন, ২০২৫ সালে ৮ মাসে ইউক্রেনের আর্মির মধ্যে ১ লাখ ৪২ হাজার ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। এই বছর আগস্টে ১৭ হাজার ৪৯৫টি অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে ইউক্রেনের আর্মির বিরুদ্ধে। ইউক্রেনের আর্মি থেকে এ পর্যন্ত ২ লাখ ৬৫ হাজার ৮৪৩ জন সদস্য অবৈধভাবে বাহিনী ছেড়ে চলে গেছে, এটা শুধু সরকারি হিসাব মতে, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বেশি হবে।

এই যুদ্ধে রাশিয়ার অগ্রগতি নিয়ে জার্মান বিশেষজ্ঞ মিস্টার রিপকি মন্তব্য করেছেন, কয়েক মাসের মধ্যে রাশিয়া উল্লেখযোগ্যভাবে যুদ্ধে অগ্রগতি সাধন করবে, রুশ বাহিনী দখল করে নেবে ক্রাসনায়ারক্স, দিমিত্রভ, কন্সতান্তিনোভা, সেভারকস ও কুপিয়ানস্ক। নিউইয়র্ক টাইমসও এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে।

পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা ও অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করতে চাইছে। কিন্তু ইউক্রেন নিজেদের মধ্যে যদি এ রকম দুর্নীতি করে, আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, ইউক্রেনিয়ান আর্মির তাহলে অবস্থা কী দাঁড়াবে?

এদিকে গত কয়েক দিনে, রাশিয়া তার ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যাপক হারে ব্যবহার করছে। শুধু গত শনিবারে ৫৯৫টি ড্রোন ও ৪৮টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে ইউক্রেনে। এসব ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে জ্বালানি, বিদ্যুৎকেন্দ্র, ট্রেনলাইন ও ট্রেন স্টেশনের দিকে। গ্যাসস্টেশন ও তেল শোধনাগারেও হামলা চালিয়েছে। এসব হামলা চালিয়েছে খারকভ ও কিয়েভের পার্শ্ববর্তী এলাকায়, কোনো কোনো সময় কিয়েভ শহরেও হামলা চালিয়েছে। রাশিয়া কত দূর পর্যন্ত অগ্রসর হবে, সেটা বোঝা যাচ্ছে না। রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের ভয়ে গত শুক্র ও শনিবার পোল্যান্ড তার আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে। ইউক্রেনের ভেতরেই আর্মি, সরকারি কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষের মধ্যে দোদুল্যমানতা চলছে, বিভিন্ন সংস্থা একে অপরকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

তবে রাশিয়ার জনগণ ভ্লাদিমির পুতিনকে আস্থায় নিয়েছে। তারা মনে করছে, পুতিন রাশিয়াকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত একটা অর্থনীতি, জনগণের মধ্যে অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি থেকে আড়াই দশকের মধ্যে একটি জাতিকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, সেটা পুতিন সারা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন।

পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার ওপর ১৬ হাজার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, রাশিয়ার অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে চেয়েছে। কোনো কোনো দেশ তেল ও গ্যাস কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে চাপে ফেলার জন্য আমেরিকাসহ পশ্চিমা মিত্ররা তাদের মিত্রদেশগুলোকে চাপ দিচ্ছে রাশিয়া থেকে তেল ও গ্যাস না কেনার জন্য। রাশিয়ার তেল ও গ্যাস তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ইউরোপ কিনছে। রাশিয়া পশ্চিমাদের এসব নিষেধাজ্ঞা পরোয়া না করে চীন ও ভারতকে সঙ্গে নিয়ে, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে তার বাজার সম্প্রসারণ করেছে। রাশিয়ার ভেতরে সাধারণ জনগণ যুদ্ধের পরিণতির খারাপ কোনো দিক অনুভব করছে না। অর্থনীতি সচল রয়েছে, সাধারণ মানুষের কাজের অভাব হয়নি। যুদ্ধকালীন অর্থনীতি আরও চাঙা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি আয়ত্তের মধ্যে আছে এবং দ্রব্যমূল্যের কোনো ঘাটতি ও ঊর্ধ্বমুখী নেই।

সম্প্রতি আরআইসি গঠন করে রাশিয়া জানান দিয়েছে তাদের অর্থনীতি ধ্বংস করা যাবে না। রাশিয়ার পণ্য কেনার জন্য ভারত ও চীন সদা প্রস্তুত। রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে

সম্পর্ক ছাড়াও ব্রিকসের মাধ্যমে নতুন মুদ্রাব্যবস্থা চালু করতে চাইছে। রাশিয়া বোঝাতে চাইছে, তার অগ্রগতি রোধ করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়।

বিশ্বের কাছে সামরিক শক্তির বিশেষ আলোচনায় মর্যাদা পাচ্ছে রাশিয়া। রাশিয়া তিন মাসের মধ্যে নতুন প্রযুক্তির যেকোনো অস্ত্র বানাতে পারে এবং তা তিন মাসের মধ্যে দ্বিগুণ উৎপাদন করতে পারে। এই যুদ্ধের মধ্যেই কয়েক প্রকার অত্যাধুনিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র বানিয়ে তারা সেটা প্রমাণ করেছে। আমেরিকার আব্রাহাম ট্যাংককে সবচেয়ে ক্ষমতাধর মনে করা হয়, গত দুই বছরে এর কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। রাশিয়া এই ট্যাংকের তুলনায় অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন ও প্রযুক্তিসম্পন্ন ট্যাংক বানিয়েছে। রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা অন্যান্য দেশের বিজ্ঞানীদের তুলনায় কোনো অংশে কম নন। রাশিয়ার পারমাণবিক শক্তি বিশ্বের মধ্যে এক না দুই—সেটা হিসাব করা কিন্তু কষ্ট। সবকিছু বিবেচনা করতে হবে এটা মাথায় রেখে, রাশিয়ার ওপর ন্যাটো সামরিক শক্তি প্রয়োগ করবে কি করবে না?

যেভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট হুমকি দিচ্ছেন রাশিয়াকে, তাতে মনে হয় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমাদের তৎপরতা কিন্তু সেই ইঙ্গিত দেয়। রাশিয়াও সেইভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখনো সময় আছে বিশ্বনেতাদের রাশিয়ার ব্যাপারটিকে সিরিয়াসলি নিয়ে সমাধানের দিকে এগোনো।

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগে যে কথা বলেছিলেন, বর্তমানে তিনি তার উল্টোভাবে কাজ করছেন। এ যুদ্ধের পরিকল্পনা থেকে বের হয়ে শান্তির পথে অগ্রসর হওয়া উচিত, সুস্থ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ তাই মনে করে, শক্তি প্রয়োগ করে রাশিয়াকে পরাজিত করা যাবে না। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলে এটা হবে পারমাণবিক যুদ্ধ। রাশিয়ার লোকসংখ্যা সাড়ে ১৪ কোটি, সেনাবাহিনীর সদস্যসংখ্যা ১৫ লাখ, সবদিক থেকে রাশিয়াকে আক্রমণ করলে, এই যুদ্ধ পারমাণবিক যুদ্ধে রূপ নেবে নিশ্চিত করে বলা যায়। রাশিয়া তার পারমাণবিক অস্ত্র এমনভাবে তাক করে রেখেছে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর দিকে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এসব দেশকে আক্রান্ত করতে পারবে।

লেখক: প্রকৌশলী

আমাদের অভ্যুত্থান পর্বটা এখনো শেষ হয়নি

ঢাকা শহরে খোলা জায়গার বড় অভাব

রাজনৈতিক পরিস্থিতি কি খুবই অস্থিতিশীল!

বায়ুদূষণ: আজকের ভুলে আগামীর ঝুঁকি

নারীরা কি মানুষ নয়

যেখানে মুক্তিযুদ্ধ বেঁচে থাকে

মা কুকুর ও তার আটটি ছানা

যেথায় হাওয়ায় ভাসে ফুলের কান্না

মিসরের আরেকটি নামকাওয়াস্তে ভোট

ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কি থাকছে