সরকারের একজন দায়িত্বরত ব্যক্তি নাকি বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে ইতিহাসের সর্বোত্তম নির্বাচন। সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন একটা পোস্ট বেশ ঘোরাঘুরি করছে। চোখে লাগল কথাটা বেশ। মনে মনে প্রশ্ন করলাম, তাই নাকি? হলে তো ভালোই। জনগণ তো যুগ যুগ ধরে সেটাই চেয়ে এসেছে।
একটা সুষ্ঠু ও সুন্দর নির্বাচন হলে তো রাষ্ট্রের জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা থাকে জনগণের কাছে। ব্যক্তি, গোষ্ঠী নয়, জনগণই যে সর্বোচ্চ ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী—এমন সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও ইদানীং অনেক কথাই শুনি, যার আগামাথা বুঝতে পারি না। মনে হয়, বুঝবার মতো জ্ঞান হয়নি। কিংবা ওসব হারিয়ে গেছে।
সত্যি বলছি, তেমনই লাগে। এমনকি নিজেকে এসব কথাবার্তায় বড্ড বেমানান লাগে। অচল লাগে। যা জেনে এসেছি, শিখে এসেছি সবকিছুই অর্থহীন মনে হয়। ফলে কথা বলা, আলোচনায় অংশগ্রহণ করা কমে গেছে। শোনা যায়, আজকাল নাকি বেশি কথা বলা যায় না। ভয় নামক একটা শব্দ তার প্রচলন বাড়িয়েছে। কিন্তু এমন তো কথা ছিল না। কথা রাখেনি কেউ!
যাহোক, ফেব্রুয়ারির নির্বাচন নিয়ে অবশেষে রাজনৈতিক দলগুলো বেশ সরব হয়েছে। যদিও দলগুলোর ভেতর অন্তর্কলহ দূর হয়নি মোটেও। চিরাচরিত নিয়মে রাষ্ট্রশাসনের ক্ষমতার মোহ কমবেশি প্রায় সবারই। কর্মী থেকে শুরু করে নেতা, যোগ্য, অযোগ্য ব্যক্তি সবাই রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন চান। ফলে কলহ বাড়ে। দল ভাঙে। সম্প্রতি দেখা গেল বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের কয়েকজন নেতা মনোনয়ন না পাওয়ায় তাঁর কর্মী-সমর্থকেরা বিক্ষুব্ধ হয়ে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করেছেন। এমন দৃশ্য দেখার জন্য কিন্তু সাধারণ জনগণ অপেক্ষায় ছিল না। সাধারণ জনগণের চিন্তাচেতনা বদলেছে। অতীতের ঘটনা পুনরাবৃত্তি হোক, তা সাধারণ জনগণ আর প্রত্যাশা করে না কোনোভাবেই। কিন্তু ক্ষমতায় আসীন হওয়ার যে রোগটা, সেই রোগটা কিন্তু ঘুরেফিরে থেকেই যাচ্ছে, নিরাময় অযোগ্য থেকে যাচ্ছে।
একটা শ্রেণির মানুষ ভেবে বসেই আছে, নির্বাচন হবে না। আরেকটা শ্রেণির জনগণ নির্বাচন নিয়ে সংশয়ে আছে। বলছে, এটা আইওয়াশ, পাতানো খেলা। আবার আরেকটা শ্রেণি মনে করে, নির্বাচন হতেই হবে। নির্বাচন হবে। নির্বাচিত সরকার ছাড়া এই দেশ ঠিকমতো পরিচালিত হবে না, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দূর হবে না। সাধারণ জনগণের অধিকার, নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। বৈষম্য থেকে যাবে। যদিও প্রশ্ন ওঠে, অতীতে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার কি দেশকে স্থিতিশীল করতে সমর্থ হয়েছিল? উত্তর, শতভাগ না। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক নিরাপত্তার যে হাল, সেটা ছিল না। মব সন্ত্রাস, ইচ্ছে হলেই আইন হাতে তুলে নেওয়া, চাঁদাবাজি, প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা, কাউকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করা, অবমূল্যায়ন করা ইত্যাদি এখন বেশ দৃশ্যমান।
অতীতে এসব থাকলেও মাত্রা ছিল কম। পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে অনেকেই চিন্তিত। তারা অতীতের মতো সক্রিয় নয় বলে এই শ্রেণির ধারণা। একজন বলছিলেন, পুলিশের ভেতর মনে হয় চাপা অভিমান কাজ করছে, তারা জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তেমন সক্রিয় হচ্ছে না। পুলিশ প্রশাসন তো সব সরকারের এবং রাষ্ট্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রাজনৈতিক সরকার তাদের নিজেদের স্বার্থে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। সরকারের আদেশ বা সিদ্ধান্ত অমান্য করা, এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা তাদের থাকে না। বিশেষ করে মধ্যম ও নিম্ন পর্যায়ের সদস্যদের। অতীতে পুলিশ প্রশাসনকে প্রতিটি রাজনৈতিক সরকার কীভাবে ব্যবহার করেছে সেটা সবাই জানে।
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে জনগণের হত্যার বিচারের বিষয়ে কথা উঠলেও পুলিশ হত্যার বিষয়ে কিন্তু কথা উঠতে দেখা যায়নি। যাঁরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, তাঁদের সম্পর্কে কোনো তথ্যও প্রকাশ পায়নি। যেকোনো হত্যাকাণ্ডই কাঙ্ক্ষিত নয়। অপরাধের জন্য শাস্তির বিধান থাকে। ছাত্র-জনতার নির্মম হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া যেমন শুরু হয়েছে, তেমন করে পুলিশ হত্যার বিচারও হওয়া দরকার ছিল বলে অনেকেই মনে করেন। সেই সময় গণহারে পুলিশ হত্যা পুলিশ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার কারণ বলে তাঁরা মনে করেন।
সম্প্রতি মফস্বল ও গ্রামে যেতে হয়েছে কাজে। চোখে পড়ল নির্বাচনী হাওয়া। এইসব অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ নির্বাচনে আগ্রহী। তাদের নিজেদের পছন্দের দল ও নেতা আছে। যদিও এবার আওয়ামী লীগকে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে নির্বাচনপ্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা হয়েছে। ফলে গ্রামাঞ্চলের লোকজনের ভেতরে আওয়ামী লীগের বিকল্প প্রার্থী পছন্দের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তাদের কেউ কেউ দ্বিধান্বিত পছন্দ নিয়ে। এখানে একটা কথা বলাবাহুল্য যে মুক্তিযুদ্ধ ও নারীর অধিকার বিষয়ে এই দেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষ বেশ সচেতন। একটা সুস্থ, সুন্দর ও নির্মল চিন্তাচেতনায় জীবনযাপনে পক্ষপাতী তারা। এই সত্য প্রমাণের উত্তম পন্থা একটা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া।
এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে চব্বিশের বৈষম্যবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে একপর্যায়ে বিশাল জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততার কারণ ছিল নিরীহ ছাত্র-জনতা হত্যাকাণ্ড, বিশেষ করে শিশুদের নির্মম ও অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর বিষয়টি। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ কখনোই অন্যায়, অত্যাচার বিশেষ করে ছাত্র, শিশুহত্যা মেনে নিতে পারেনি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অবতারণা তারই দৃষ্টান্ত। ২০২৪-এ তারই পুনরাবৃত্তি। একটা স্বাধীন দেশে এমন ঘটনা কখনোই আশা করা যায় না, কল্পনাতীত বটেই।
জনগণ সমর্থিত সরকার গঠনে নতুন রাজনৈতিক দলসহ সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করলে তুলনামূলকভাবে ভালো ফলাফল পাওয়া যেত বলে অনেকের ধারণা। তবে এটা ঠিক যে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে কমবেশি সবারই একধরনের অনীহা দেখা গেছে সব সময়। নির্বাচন নিয়ে জনমনে যে আশঙ্কা, তা কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলে না। বরং আদতে কী হয় বা হবে, তা নিয়ে হাজারো গল্প-কেচ্ছা। তবে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আশা করি জনগণ তাদের সঠিক রায় দিতে সমর্থ হবে। আর
আমরা সেটাই চাই।