মানুষের জীবনের একটা অনিবার্য পরিণতি—মৃত্যু, সে এক প্রাকৃতিক বিষয়। যেমন মেঘ, বৃষ্টি, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত—যার ওপর মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, তেমনই। কিন্তু কিছু মানুষের মৃত্যু হলে আমরা বলে থাকি, একটা শূন্যতার সৃষ্টি হলো, যে শূন্যতা দেখা যায় না, কিন্তু অনুভব করি আমরা বহু দিন, বহু বর্ষ, বহু শতাব্দী। তেমনি সাম্প্রতিককালে আমরা একটা মৃত্যুর মিছিল দেখছি, যার সূচনা হয়েছে যতীন সরকার থেকে। যতীন সরকার ছিলেন নেত্রকোনার বারহাট্টা গ্রামের একজন ছাপোষা শিক্ষক। দেশ বিভাগের আগে একজন শিক্ষক কেমন ছিলেন, তা সহজে অনুমান করা যায়। কিন্তু তিনি বলেও গেছেন ছাত্রদের এবং কৌতূহলী মানুষদের, সেগুলো পাঠ্যপুস্তকের বিষয় নয়, আবার পাঠ্যবই থেকে পড়িয়েছেনও।
তাঁর অনেক মূল্যবান লেখার মধ্যে একটি লেখা, ‘পাকিস্তানের জন্ম মৃত্যু দর্শন।’ এই বইয়ে তিনি দার্শনিকতার সংজ্ঞা নির্ণয় করতে গিয়ে একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। সেটি হচ্ছে, একটা পুকুরপাড়ে দেখা গেল অনেক মানুষের জটলা, কৌতূহলবশত সেখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে কী হয়েছে?’ উত্তরে একজন এসে বললেন, ‘ঐ যে পুকুরে মাছ ধরছে।’ এর পরের জিজ্ঞাসা, ‘আপনারা কী করছেন?’ উত্তর, ‘আমরা দার্শনিক।’ কথাটা নেত্রকোনার একটি আঞ্চলিক কথা বটে, কিন্তু যতীন সরকার তাকে একটা দার্শনিক অভিধা দিয়েছেন। যিনি দর্শন করেন, তিনি তো দার্শনিক বটেই। পৃথিবীর সব দার্শনিকের দর্শনচিন্তার শিকড় তো সেটাই, কিন্তু তারপর তিনি কী দেখেন? শুধুই কি দেখা, নাকি এই দেখা মানবজাতির অভিজ্ঞতায় নতুন একটা উপাদান হিসেবে যুক্ত হলো, সেটাই দেখার বিষয়। যতীন সরকার লিখেছিলেন, ‘পাকিস্তানের জন্ম মৃত্যু দর্শন’। তিনি পাকিস্তানের জন্ম দেখেছিলেন, মৃত্যুও।
তাই তার আনুপূর্বিক বিষয়াদি নিয়ে তাঁর ভাবনা উপস্থিত করেছিলেন। পাঠক তাতে ঋদ্ধ হয়েছিল। এভাবে কোনো রাষ্ট্র নির্মাণ করা যায় কি না, তার ভবিষ্যৎই-বা কী দাঁড়ায়? বরং চিরতরে একটা সাম্প্রদায়িকতার উৎস এবং ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারকেই বেগবান করে তোলে। বাংলাদেশের প্রতিটি ঘটনায় তার উদ্বেগ শুধু নয়, একটা ব্যাখ্যাও আমাদের আলোড়িত করত। প্রায়ই একই সময়ে আরেকজন শিক্ষক, তিনি এসেছেন পশ্চিম বাংলার বর্ধমান ও কলকাতা থেকে—বদরুদ্দীন উমর।
পিতা আবুল হাশিমের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন দেখেছেন কিন্তু ছোটবেলা থেকে পরিবারের অন্য আত্মীয়দের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং সেই প্রভাব ছিল সাম্যবাদের পক্ষে। পাকিস্তানের দার্শনিক ভিত্তিটায় তিনি প্রথমেই আঘাত করেন। তাঁর যুগান্তকারী রচনা ‘সাম্প্রদায়িকতা’ ও ‘সংস্কৃতির সংকট’। বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের সংকটটিতেই যাদের ভাবনায় দেখা দেয়—‘আমরা বাঙালি না মুসলমান’। এই সময়ই তিনি ‘ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ নামক বইটি লিখেছিলেন। সংকটটা যে তখন শুধু ভাষার ছিল না, সঙ্গে ছিল আরও অনেক ধরনের বাস্তবতা, তা এত সবিস্তারে যুক্তিসহযোগে তাঁর মতো আর কেউ উপস্থাপন করেননি। আমৃত্যু তিনি নিরলসভাবে বাংলা ও ইংরেজিতে লিখে গেছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভাষা আন্দোলন এতই গুরুত্বপূর্ণ এক ফলক, যাকে স্পর্শ না করে কোনোভাবেই হাঁটা যায় না। সেই পথ, সেই ঘটনার সাক্ষী আরেক লেখক, গবেষক আহমদ রফিক। পেশায় চিকিৎসক। ভাষা আন্দোলনের সময় ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র। ভাষা আন্দোলনের সাক্ষী শুধু নন, সংগঠক, নেতা এবং আজীবন ভাষার আলো তিনি ছড়িয়ে গেছেন। লেখক হিসেবে তাঁর দিগন্ত বিস্তৃত, কিন্তু তিনি শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, ভাষার দর্শনেরও প্রবক্তা।
সম্প্রতি এই মৃত্যুর মিছিলে যিনি যুক্ত হয়েছেন, তিনি বয়সে তাঁদের চেয়ে ছোট হলেও ছিলেন দর্শনের ছাত্র। নিজেকে তিনি কখনোই শিক্ষক ভাবতেন না; বরং ছাত্র ভাবতেই অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি দর্শনকে ব্যাখ্যা করতে ভালোবাসতেন। সেই সঙ্গে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে একটা দিগন্তে তাঁর বিচরণ তো ছিলই। বিপুলসংখ্যক ছাত্র-অছাত্র-পাঠকের মধ্যে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের একটা প্রভাব তৈরি হয়েছিল, যা তাঁর মৃত্যুর পর নানা মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি গল্প, নাটক লিখেছেন, অসংখ্য প্রবন্ধের রচয়িতাও। এ দেশে যা একেবারেই দুর্লভ, সেই কাজও তিনি করেছেন। তা হলো চিত্রকলা ও সাহিত্যের সমালোচনা। এ কাজগুলো হয়তো আরও অনেকে করে থাকেন, কিন্তু মনজুরের যে আত্মগত অঙ্গীকার, তা একেবারেই দুর্লভ। স্বপ্রণোদিত হয়ে কোনো শিল্পীকে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত করার কাজটিও তিনি প্রায় নিয়মিতই করতেন; বিশেষ করে তরুণদের নিয়ে। তিনি তরুণদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন নিয়মিত। সর্বোপরি আধুনিকতায়, চিন্তায়, মননে ও ব্যবহারিক জীবনে সব সময় আধুনিকতার চর্চাকে উৎসাহিত করতেন প্রবলভাবে। আধুনিক মনন একবার গ্রহণ করলে পূর্বাপর তাবৎ জ্ঞানকে একটা পরিশীলিত এবং সময়োপযোগী হিসেবে গ্রহণ করাটা সহজ হয়। সাধারণত মতাদর্শগত জ্ঞান এবং ভাবনা যদি গভীরভাবে মননে প্রোথিত হয়ে যায়, তাহলে মুক্তবুদ্ধিকে ধারণ করাও কঠিন হয়ে যেতে পারে।
যতীন সরকার যখন জন্মেছিলেন, তখন পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক দর্শন মার্ক্সবাদের প্রভাব সারা বিশ্বে স্পন্দিত হয়েছিল। বস্তুবাদী দর্শনের নিরিখে একধরনের গবেষণালব্ধ এবং যুক্তিতর্কের উপস্থাপনার সময় এসেছিল। বাড়ির পাশেই দেখতে পেয়েছিলেন টংক বিদ্রোহ, হাজং বিদ্রোহ। সেই সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভারতীয় গণনাট্য সংঘ—এসব তাঁর চিন্তাকে নিশ্চয় অনুপ্রাণিত করেছিল। কিন্তু ওই পাকিস্তানের জন্ম মৃত্যু দর্শনের মধ্য দিয়ে একদা আবিষ্কার করলেন, তিনি সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছেন। সংখ্যালঘুর সেই জটিল নিরাপত্তাহীনতা সত্ত্বেও তিনি তাঁর
কথা নিঃসংকোচে লিখে গেছেন এবং প্রগতিশীল রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছেন।
বদরুদ্দীন উমরও ছিলেন একই সময়ের মানুষ। মার্ক্সবাদের দীক্ষায় তাঁর যৌবন ও উত্তরকাল কেটেছে। বাম রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক তাঁর এতই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের কাজ ছেড়ে তিনি সার্বক্ষণিক রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে রাষ্ট্র, সমাজ, সরকার—সবই ছিল তাঁর তুখোড় সমালোচনার ক্ষেত্র। রাজনীতি কখনো দার্শনিকতা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চার বাইরে চলে যায়। যুক্তি কখনো একপেশে হয়ে
যায়। তিনি একই মতাদর্শের মানুষেরও সমালোচনা করতেন। কাউকে ছেড়ে কথা বলতেন না। একটা সমাজে এখন এ রকম মানুষের প্রবল অভাব।
ভাষা আন্দোলনের সৈনিক, সংগঠক, সাক্ষী আহমদ রফিক শুধু চিকিৎসক হিসেবেই জীবনটা পার করে দিতে পারতেন। ভাষা আন্দোলন তো বটেই, নব্বই-ঊর্ধ্ব জীবনে শিক্ষকের পেশা ছেড়ে দিয়ে তিনি সাহিত্যেও মনোনিবেশ করেছিলেন, কিন্তু চিন্তায় ছিলেন প্রগতিশীল। সুদীর্ঘ জীবনে একজন মানুষ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে যাঁরা লড়াই করেন, তিনি ছিলেন তাঁদেরই একজন।
গত ৫৪ বছরের রাজনীতিতে সরকার সমাজের কথা ভাবেনি। রাষ্ট্রও নিরপেক্ষ ও মানবিক হতে পারেনি। পাকিস্তানের প্রায় ২৪ বছর এবং পরে বাংলাদেশের ১৫ বছরের বেশি সময় একটা অগণতান্ত্রিক সামরিক ব্যবস্থার মধ্যে চলেছে।
তাই সমাজে মূল্যবোধ তৈরি হওয়ার কোনো সুযোগই ঘটেনি; বরং রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতাকে করায়ত্ত করার জন্য কালক্ষেপণ করেছে। এই ব্যবস্থায় অর্থ এসে দাঁড়িয়েছে একটা কেন্দ্রস্থলে। সব ক্ষেত্রে পেশাদারি সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারেনি। সামরিক বাহিনীও ব্যবহৃত হয়েছে এর পাহারাদার হিসেবে। আজকের সামগ্রিক বিশৃঙ্খলা তারই প্রতিফলন। যে সময়ে এই মানুষগুলো লোকান্তরিত হলেন, সে-ও এক অস্থির সময়। তাঁদের মূল্যায়নের জন্য এই সময়টি তেমন সুস্থির সময় নয়। এই শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য অনাগতকালে কোনো মহৎ মানুষের জন্ম হবে কি না, তা-ও অনিশ্চিত। অসংখ্য রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেছে, পাশাপাশি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু বিপুল বিশাল জনগোষ্ঠীর আবাসভূমি কী করে নিরাপদ হবে, তার ভাবনা কোথায়?
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব