হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

বিজয়ের মাসে শঙ্কার কথা বলি

বিধান রিবেরু

আমরা এমন এক সমাজের স্বপ্ন দেখি, যেখানে নানা ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের মানুষ পরস্পরের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করবে। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জারিত হয়ে সমাজের বৈচিত্র্যকে উদ্‌যাপন করবে। আমরা এমন এক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখি, যে রাষ্ট্র প্রত্যেক নাগরিকের মানবিক মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখবে। বৈষম্য ও দারিদ্র্যকে মুখে মুখে নয়, প্রকৃত অর্থেই জাদুঘরে পাঠাবে। এমন সমাজ ও রাষ্ট্র পাওয়ার স্বপ্ন আমরা মূর্ত করে তুলেছিলাম ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। কিন্তু গন্ডগোলটা বাধল যখন একটি গোষ্ঠী বা ব্যক্তি নিজের মত ও বিশ্বাসকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করতে শুরু করল এবং চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। এতে করে সমাজে দেখা দিল সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ, রাষ্ট্রে প্রতিভাত হলো স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ।

একটি সমাজে নানা মত ও পথের মানুষ থাকবে। বিশ্বাসী থাকবে। অবিশ্বাসী থাকবে। সবাইকে নিয়েই সমাজ ও রাষ্ট্র। ভিন্ন ভিন্ন দল ও মতের হয়েও তাহলে কেমন করে মানুষ এক সূত্রে গাঁথা থাকবে? কেমন করে একটি মানচিত্রের ভেতর চিহ্নিত হবে অভিন্নতা? জাতি থেকে জাতীয়তাবোধ, সেখান থেকে আমরা পেলাম জাতিরাষ্ট্র। সাতচল্লিশের আগে ভারতবর্ষে ধর্মকে জাতি ঠাওরে বা সুবিধার জন্য মনে মনে ধরে নিয়ে, দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করা হলো। কিন্তু ধর্মভিত্তিক জাতি যে সোনার পাথরবাটি, তা ১৯৭১ সালেই আমরা প্রমাণ করে দিয়েছি। জাতি গঠনে গণমানুষের সম্মিলিত কল্পনাশক্তির একটা ভূমিকা আছে সত্যি, কিন্তু সেটার সুবিধা নিয়ে কেউ যদি জাতি গঠনের জন্য ধর্মকে ভিত্তি বানায়, তাহলে বলতে হয় কেউ চোরাবালির ওপর প্রাসাদ নির্মাণের স্বপ্ন দেখছে। দুই যুগ পূরণ হওয়ার আগেই তাই স্বপ্নভঙ্গের ঘটনাও ঘটেছে। বাস্তবে আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি। তখন ভেবেছি এবার অসাম্প্রদায়িক ও সমতার সমাজ গঠন করা সহজ হবে। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো কি?

কেউ বলেন জাতি হলো এক কল্পিত জনগোষ্ঠী। কেউবা বলেন এটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য এক সম্মিলিত ইচ্ছাশক্তি। আমাদের ভেতর একটি সামাজিক অনুভূতি কাজ করে যে, আমরা সবাই একই দেশের নাগরিক। এখানে যদি ফাটল থাকে, তাহলে সে দেশের ললাট থেকে শনির দশা কাটে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যতই প্রচার করা হোক না কেন বাঙালি জাতীয়তাবাদ কিংবা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, কোথায় গিয়ে যেন তৃতীয় আরেকটি মতবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং তারা ১৯৪৭-এর দিকে তাকিয়ে ১৯৭১ সালকে গৌণ করে দিতে চায়। সাতচল্লিশে ধর্মকে জাতি জ্ঞান করে যে বিভাজন হয়েছিল, ১৯৭১ সালে কিন্তু সেই ভ্রম কেটে যায় এবং স্পষ্টতই মানুষ অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে জালিমের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। কিন্তু আজ সেই তৃতীয় পক্ষ ১৯৭১ সালকে অস্বীকার করতে চায়, ১৬ ডিসেম্বরকে বিজয় দিবস হিসেবেও তারা মানতে নারাজ। এমনকি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য এসব গুরুত্বপূর্ণ তারিখ নিয়েও কেউ কেউ অত্যন্ত আপত্তিজনক মন্তব্য করে ফেলছেন। যেটি রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল। তবে কি জাতি হিসেবে নিজেদের ভাবার ক্ষেত্রে পাটাতনে আবার সেই ধর্মভিত্তিক চিন্তাই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে? নয় তো কেন হঠাৎ আবার এত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটল? কেনইবা সমাজে ধর্মের প্রতি, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতি এই পক্ষপাত লক্ষ করা যাচ্ছে? বাংলাদেশের সমাজে ইদানীং মানুষ নিজেদের মানব, বিশ্বনাগরিক বা একটি জাতিগোষ্ঠীর পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার বদলে ধর্মপরিচয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছে, সর্বাগ্রে স্থান দিচ্ছে। এই পরিবর্তন কেন ঘটল, কেমন করে ঘটল, তার হদিস সমাজবিজ্ঞানীরা ভালো করতে পারবেন। তবে এই পরিবর্তনের দায় কোনোভাবেই রাজনীতিবিদ ও শাসকশ্রেণি এড়াতে পারবে না।

যে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরব করার মতো আত্মপরিচয় দিয়েছে, যে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যে মুক্তিযুদ্ধ প্রমাণ করেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষ এক সাগর রক্ত ঢালতে পারে অনায়াসে, সেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আজ অত্যন্ত আপত্তিকর কথা উঠছে। তারা ফিরে যেতে চাইছে সাতচল্লিশে। কী উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ! একটি গোষ্ঠী ও কিছু তথাকথিক কনটেন্ট ক্রিয়েটর নিজেদের বিপুল অনুসারী সহযোগে মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত যে ভয়ংকর মিথ্যা তথ্য প্রচার এবং চরম অপমানজনক বাক্য ব্যবহার করছে, তাতে কিংকর্তব্যবিমূঢ় না হয়ে উপায় নেই। যেকোনো সুস্থ মানুষ, যাঁরা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে সব দল-মত ও পথের ঊর্ধ্বে রেখে, যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান, ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ নারীর সম্ভ্রমের কথা মাথায় রেখে, বাংলাদেশকে নিজেদের অস্তিত্বের অংশ মনে করেন, তাঁদের প্রত্যেকেই আজ বিমর্ষবোধ করছেন। মুক্তিযুদ্ধ যে শোষণহীন ও বৈষম্যমুক্ত সমাজের আকাঙ্ক্ষা থেকে উৎসারিত পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক ও জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে জনযুদ্ধ ছিল, সেটিকে যেন ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। দেখা যাচ্ছে, অনেকে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও নির্যাতিতদের সংখ্যা নিয়ে কুতর্কের দোকান খুলে বসেছে। ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান ‘জয় বাংলা’র পর ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছিলেন কি না, সেটি আবিষ্কার করতে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। যেন শেখ মুজিবুর রহমান ‘জয় পাকিস্তান’ বললেই গোটা ৭ মার্চের উত্তাল ভাষণ ও ভাষণ শুনতে আসা লাখো মানুষের মনের ভেতর থাকা স্বাধীনতার জন্য সমুদ্রসমান কল্লোল মিথ্যা হয়ে যায়। যদিও তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে সেদিনের বিশাল জনসভায় সশরীরের উপস্থিত থাকা অনেক বিশিষ্ট মানুষই শোনেননি ‘জয় পাকিস্তান’ বলা হচ্ছে। তাহলে এখন কেন এসব ছোটখাটো কথা নিয়ে এত সময়ক্ষেপণ? এসব করলেই কি এই জনপদের মানুষ যে পাকিস্তানি শাসকদের, বলতে গেলে খালি হাতে যুদ্ধ করে পরাজিত করেছিল, তা লুকিয়ে ফেলা যাবে? কারা এই অপচেষ্টা করছে আজকে? যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে গৌরব ও অর্জনের ইতিহাস, তাই একে প্রশ্নবিদ্ধ করে তর্ক জুড়ে দিলে, মনে করা হচ্ছে মানুষ ওটা নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। আর এই ফাঁকে স্বার্থ উদ্ধার করে নেবে সুযোগসন্ধানীরা।

আরেকটি বিষয় নিয়ে কথা না বললেই নয়, ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক কারণেই ভারত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে গিয়েছিল। এটা ঠিক, তাদের জনতুষ্টিমূলক সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে চলচ্চিত্রে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হিসেবে দেখানো হয়, এটা নিয়ে আপত্তি বজায় রেখেই বলতে চাই, সে সময় ভারত পূর্ববঙ্গের লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা দিয়ে যে নজির স্থাপন করেছিল, সেটি অস্বীকার করার জো নেই। তাদের আচরণ অনেক সময় বড়ভাইসুলভ ও কিছুটা আপত্তিজনক হলেও, মুক্তিযুদ্ধে তাদের যে সেনাসদস্য মারা গেছেন তা তো আর মিথ্যা নয়। কাজেই যার যেটা প্রাপ্য তাকে সেটা দিতে হয়। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।

ইদানীং যে প্রবণতা প্রবল আকারে দেখা যাচ্ছে, সেটিকে আমি বলব, মাছির লক্ষণাক্রান্ত। ধরুন শেখ মুজিবুর রহমানের যে ভূমিকা রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে, সেটি যেকোনো বিচারেই বাংলাদেশ গঠনের পর বাকশাল গঠনের চেয়ে অনেক বড় ব্যাপার। কিন্তু আজকাল দেখি তাঁর ওই অবদানের কথা উল্লেখ না করে কেবল বাকশাল নিয়ে আলাপ করা হয়। বাকশাল নিয়ে অবশ্যই আলাপ করা জরুরি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে ছাপিয়ে সেটিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার ভেতর যে ভাষাবলয় পরিলক্ষিত হয়, যে বয়ান প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা চোখে পড়ে, সেটি হুবহু বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক ও তাদের দোসরদের বয়ানের সঙ্গে মিলে যায়। স্বাধীনতালাভের অর্ধশতাব্দী পর এসেও বাংলাদেশ-বিরোধিতা এমনভাবে ফিরে আসার জন্য আমি মনে করি বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে যাঁরা ব্যবসা করেছেন তাঁরাই মূলত দায়ী। তাঁরাই আসলে খাল কেটে কুমির এনেছেন। এখন খাল খননকারীরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পলাতক, কিন্তু জনপদের মানুষ কুমিরের ভয়ে অনিশ্চিত জীবন কাটাচ্ছে।

শুধু এটুকু বলে শেষ করি, গণতন্ত্র মানে শুধু ভোট দেওয়া নয়। ভোট দেওয়ার ভেতর দিয়ে মানুষকে গণিতে পরিণত করা হয়। মাথা গোনার আরেক নাম ভোট। গণতন্ত্র তার চেয়েও বেশি কিছু। ভোট প্রদান জরুরি, কিন্তু তার চেয়েও অধিক জরুরি এই জনপদের মানুষের কাছে গণতন্ত্রের ধারণাকে স্পষ্ট করে তোলা। এটা যত দিন না হচ্ছে, তত দিন আসলে এই খাল কাটা ও কুমিরের খেলা চলতে থাকবে। কারণ, এতে খননকারী ও কুমির উভয়েরই লাভ রয়েছে।

পথকুকুর-বিড়াল হত্যা: আইন এবং শাস্তি

জীবনের অপরিহার্য অংশ সংগীত ও শরীরচর্চা

দুর্নীতি রোগে আক্রান্ত আফ্রিকা

মার্কিন নিরাপত্তা কৌশল কি আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের ব্লুপ্রিন্ট

ইমরান খান প্রতিরোধের প্রতীক

অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি কোন দিকে

শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের ‘এত দিনে’

প্রবীণেরা কেন অধিকারবিহীন

‘আরটিএ’ চুক্তির ভবিষ্যৎ

রোকেয়ার নারী মুক্তির দর্শন