আমাদের দেশে শিল্প, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি উপভোগ করা দিন দিন সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। সিনেমা ও মঞ্চনাটক দেখা, বই কেনা আর চিত্রকলা ও ফটোগ্রাফির প্রদর্শন ও চর্চা যেন এক সীমিত জনগোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। সিনেমা দেখা একসময় সাধারণ পরিবারের সদস্যদের কাছে আনন্দ ও বিনোদনের জায়গা ছিল, আজ তা বিলুপ্তির পথে। জেলা ও উপজেলা শহরের মানুষ এখন আর মাসে একবার পরিবারের সঙ্গে সিনেমা দেখার সুযোগ পায় না। ঢাকায় যে কয়েকটি সিনেমা হল আছে, সেখানে টিকিটের দাম এত বেশি যে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষ সেসব জায়গায় গিয়ে সিনেমা দেখার সামর্থ্য রাখে না। ৫০০ টাকা থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত টিকিটের দাম দিয়ে সিনেমা দেখা মধ্যবিত্তের জন্য বিলাসিতার মতো। অথচ একসময় হুমায়ূন আহমেদের সিনেমা বা ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্র দেখার সময় পুরো হল হাসিতে ফেটে যেত বা কাঁদত—শিল্পের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ ছিল। আজ সেই সংযোগ নেই। ফলে সিনেমা দেখার আনন্দ কেবল শহুরে, ধনী, শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে।
সিনেমা হলের ধ্বংস শুধু বিনোদনের স্থান হারানো নয়, এটি আমাদের সাংস্কৃতিক জীবন ও সমাজের সমান সুযোগের অধিকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
শুধু সিনেমা নয়, কনসার্ট, লাইভ মিউজিক বা অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও একই অবস্থা। ঢাকায় কোনো বড় কনসার্টের টিকিট সাধারণত এক থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত, যা একজন সাধারণ ছাত্র বা মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে বহনযোগ্য নয়। ফলে সংগীত, নাটক বা সাংস্কৃতিক প্রদর্শনীও বিলাসিতা হয়ে যাচ্ছে, যেখানে অংশগ্রহণ করতে পারছে শুধু শহুরে ধনিক শ্রেণি।
বইয়ের দোকানও আজ বিলুপ্তির পথে। এখন আর স্কুল-কলেজে বই পড়ার প্রতি উৎসাহ দেখানো হয় না। এলাকার বইয়ের দোকানগুলোতে শুধু একাডেমিক বা চাকরির বই পাওয়া যায়। গল্প, কবিতা, ছোটগল্পের বই সেখানে দুর্লভ বস্তু। একসময় শিশু-কিশোররা টিফিনের টাকা দিয়ে ‘তিন গোয়েন্দা’ কিনে পড়ার আনন্দে ভেসে যেত। আজ সেই দৃশ্য আর সেভাবে চোখে পড়ে না। ঢাকার বইয়ের দোকানগুলো মূলত শহুরে এলিটদের জন্য। বাতিঘর, পাঠক সমাবেশ, বেঙ্গল বুকসে গিয়ে সবাই বই কেনার সামর্থ্য রাখেন না। আজিজ সুপার মার্কেট, কনকর্ড টাওয়ার ও নিউমার্কেটে আগের মতো বইয়ের দোকানের জৌলুশ নেই।
সাত-আট বছর আগে নীলক্ষেত দিয়ে হেঁটে গেলে অসংখ্য গল্পের বইয়ের দোকান চোখে পড়ত। এখন সেসব দোকান আর নেই। সব চাকরির বই দিয়ে ভরা। আবার বিভিন্ন কারণে বই পড়ার আগ্রহ কমে গেছে। সে জায়গা দখল করেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।
শিল্পকলায় মঞ্চনাটক দেখা, ফটোগ্রাফি ও চিত্রকলার প্রদর্শনী—সবই এখন মূলত ধনী, শহুরে শ্রেণির জন্য। টিকিটের দাম এত বেশি যে একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে এগুলো দেখা সম্ভব নয়। শহুরে ধনিক শ্রেণি ছাড়া অন্যরা এ ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যেতে পারেন না। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি কি কেবল একটি শ্রেণির জন্য? আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে—এ ধরনের ব্যয়বহুল সাংস্কৃতিক আয়োজন কি সত্যিই শিল্পের বিস্তার ঘটাতে পারে? মানুষ শিল্প ও সাহিত্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, কারণ সেখানে টাকার খেলা প্রাধান্য পাচ্ছে।
শিল্পের সঙ্গে সংযোগ থাকলেও যদি তা ব্যয়বহুল, সীমিত বা বিলাসিতার মতো মনে হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের কাছে তা পৌঁছায় না। সংস্কৃতি কেবল শহুরে ধনীর খেলা হয়ে গেলে সমাজের বৃহত্তর অংশ তা থেকে বঞ্চিত হয়। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তও শিল্প-সাহিত্যকে দেখতে চায়, পড়তে চায়, অনুভব করতে চায়। কিন্তু টাকার কাছে বাধা, সুযোগের অভাব এবং অযাচিত সীমাবদ্ধতা তাদের থেকে শিল্পকে দূরে রাখছে।
শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রসার কেবল শ্রেণির অভিজ্ঞতা নয়, এটি সমাজের মানসিক ও নৈতিক বিকাশের অংশ। তাই আমাদের এই সংকট কাটানো উচিত। সিনেমা, বই, নাটক, প্রদর্শনী—সবকিছু যেন সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছাতে পারে, সেই প্রচেষ্টা থাকা দরকার। শিল্প শুধু বিলাসিতা নয়, মানুষের জীবনের অপরিহার্য অংশ।
আমরা যদি শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে একটি শ্রেণির বা ধনীর খেলা বানাই, তাহলে আমাদের সমাজের সাংস্কৃতিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সাধারণ মানুষকে এই সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত না করা উচিত। সবকিছুতে টাকার খেলা কমিয়ে, সাংস্কৃতিক বিস্তার সবার জন্য নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শিল্প, সাহিত্য এবং সংস্কৃতিকে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দরকার।