মানুষ সহজ সমাধান পছন্দ করে, বিশেষ করে, যখন সেটিতে অল্প পরিশ্রমে বা বিনিয়োগে অধিক মুনাফা পাওয়া যায়। ধরুন, একটি দেশে ব্যাপক বেকারত্বের সমস্যা, সে দেশের যুবকদের দ্রুত ধনবান হওয়ার উপায় বাতলে দিয়ে আপনি নিজ স্বার্থ হাসিল করতে পারেন। বাংলাদেশেও অবশ্য পেরেছেন অনেকেই—ডেসটিনি, ইভ্যালি থেকে শুরু করে সমুদ্রপথে বিদেশযাত্রার মধ্যস্থতাকারী বা দালালেরা।
সম্প্রতি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান নারীদের জন্য তেমনই স্বল্প পরিশ্রমে অর্থ উপার্জনের এক লোভনীয় প্রস্তাব হাজির করেছেন, সঙ্গে দিয়েছেন কিছু মায়া-মমতার প্রলেপ। তিনি বলেছেন, জামায়াত ক্ষমতায় গেলে অফিস-আদালতে নারীদের কর্মদিবস পাঁচ ঘণ্টার হবে। এটি ইশতেহার নাকি সুপারশপের সুপার ডিসকাউন্ট, তা ঠাহর করা মুশকিল।
জামায়াত আমিরের কথা শুনে অনেকে হয়তো ভাবছেন, আহা, কী মানবিক প্রস্তাব! নারীরা সন্তান ও সংসারের জন্য বেশি সময় পাবেন। কিন্তু এই ‘সহমর্মিতা’ আসলে এক চোরাবালি, যা নারীর কর্মজীবন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও মর্যাদাকে গ্রাস করবে; তাঁকে বন্দী করে ফেলবে গায়েবি এক শিকলে।
কর্মসংস্থানের দুনিয়া আবেগে চলে না, এটি চলে সময়, শ্রম, দক্ষতা ও মুনাফার মাপকাঠিতে। যদি রাষ্ট্রই ঘোষণা দেয়, নারীরা দিনে পাঁচ ঘণ্টা কাজ করবেন, তাহলে নিয়োগকর্তার চোখে তাঁরা ‘কম দায়বদ্ধ’ কর্মী হয়ে যাবেন। ফলে ভালো চাকরির সুযোগ, পদোন্নতি, এমনকি কর্মস্থলে সম্মান—সবকিছু থেকে ধীরে ধীরে নারীরা বাদ পড়বেন।
সমাজবিজ্ঞানী শেলি কর্নেল বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছেন ‘মাদারহুড পেনালটি’ বা ‘মাতৃত্বের শাস্তি’ নামে। তত্ত্বটি বলে, একজন নারী যখন মা হন, তখন কর্মক্ষেত্রে তাঁকে একধরনের অদৃশ্য জরিমানা গুনতে হয়। একই যোগ্যতা থাকার পরেও শুধু ‘মা’ হওয়ার কারণে তাঁর বেতন কমে যায়, পদোন্নতির সম্ভাবনা ক্ষীণ হয় এবং তাঁকে কম দায়িত্বপূর্ণ কাজের উপযোগী মনে করা হয়। সমান যোগ্যতার দুই আবেদনকারীর মধ্যে ‘মা’ পরিচয়ধারী নারী প্রায়ই প্রত্যাখ্যাত হন। কারণ, নিয়োগকর্তার মনে এ ধারণা কাজ করে যে, ‘মা কর্মী’ সন্তানের কারণে কাজে পুরোপুরি মন দিতে পারবেন না।
এখন যদি রাষ্ট্রীয়ভাবে মা বা নারী কর্মীদের কর্মঘণ্টা কমানো হয়, এই অদৃশ্য শাস্তিটি তখন আইনি রূপ পাবে। নিয়োগকর্তা তখন আর দ্বিধায় ভুগবেন না। একজন আট ঘণ্টা কর্মক্ষম কর্মীর সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টার ‘নারী’ কর্মীকে তিনি কেন সমান গুরুত্ব দেবেন? যে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোতে দীর্ঘ সময় আর নিবিড় মনোযোগ দরকার, সেখান থেকে নারীরা স্বাভাবিকভাবেই বাদ পড়ে যাবেন। এই নীতি তখন উল্টো এক বড় প্রতিবন্ধক হয়ে উঠবে। যে ‘সহমর্মিতা’ দেখিয়ে তাঁদের কর্মঘণ্টা কমানোর কথা বলা হচ্ছে, সেই সহমর্মিতাই তাঁদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পথ রুদ্ধ করে দেবে।
বিষয়টি বুঝতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনের অধ্যাপক জোয়ান সি উইলিয়ামসের ‘ম্যাটারনাল ওয়াল’ ধারণা আমাদের আরও সাহায্য করবে। এটি সেই অদৃশ্য দেয়ালকে বোঝায়, যেটি মা বা নারী কর্মীদের কর্মক্ষেত্রে ‘আদার’ বা ‘অপর’-এ পরিণত করে। পাঁচ ঘণ্টার নীতি এ দেয়ালকে আরও ইস্পাতকঠিন করে তুলবে। অফিসের কর্মীরা তখন ভাগ হয়ে যাবেন দুই দলে—একদিকে নারী ও অপর দিকে অন্যরা। নারীদের জন্য তৈরি হবে এক ধীরগতির ক্যারিয়ারপথ বা মমি ট্র্যাক। এই পথে হয়তো সাময়িক স্বস্তি আছে, কিন্তু পদোন্নতি, নেতৃত্ব, প্রভাব ও চ্যালেঞ্জিং দায়িত্বের মতো বিষয়গুলো তাঁদের জন্য একরকম নিষিদ্ধ হয়ে যাবে।
এখানে অর্থনৈতিক বাস্তবতাটি ভয়াবহ! ২০২২ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৪৩ শতাংশ নারী দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক খাতে কর্মরত রয়েছেন। যদি তাঁদের কর্মঘণ্টা আট থেকে পাঁচে নেমে আসে, বেতনও কি আনুপাতিক হারে কমবে না? যদি কমে, নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কমে যাবে। তাই এটি আসলে নারীকে অর্থনৈতিকভাবে পরাধীন করে আবারও গৃহবন্দী করার ফাঁদ। আর যদি সরকার বলে, বেতন কমবে না, তখন নিয়োগকর্তারা বলবেন, ‘আমরা আট ঘণ্টা কাজের সমান বেতন দিয়ে পাঁচ ঘণ্টা কাজ করাব কেন?’ ফলে অলিখিতভাবে নারী নিয়োগ বন্ধের নীতি প্রতিষ্ঠা পাবে।
অর্থনীতিবিদ এডমুন্ড ফেল্পস ও কেনেথ অ্যারো এ ধরনের আচরণকে ব্যাখ্যা করেছেন ‘স্ট্যাটিসটিক্যাল ডিসক্রিমিনেশন’ নামে; যেখানে কোনো গোষ্ঠীর গড় আচরণের ওপর ভিত্তি করে বৈষম্য করা হয়। পাঁচ ঘণ্টার নীতি এই বৈষম্যকে বৈধতা দেবে। নিয়োগকর্তা তখন যুক্তি দেখাবেন, রাষ্ট্রই বলেছে, নারীরা কম কাজ করবেন, তাই তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া নিরাপদ নয়।
রাজনীতির দিক থেকেও এই প্রস্তাব গভীর সংকেত দেয়। বাংলাদেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর ভূমিকাকে সব সময় খাটো করে দেখা হয়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নারীরা স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করলেও ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরে তাঁরা আর গুরুত্ব পাচ্ছেন না। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর কাঠামো—সব জায়গায় নারীদের অবস্থান প্রান্তিকই রয়ে গেছে। এমন বাস্তবতায় নারীর কর্মঘণ্টা কমানোর অফার আসলে তাঁকে ঘরবন্দী করার নতুন কৌশলমাত্র।
জামায়াত আমির অফিস-আদালতে নারীর কর্মঘণ্টা কমানোর বদলে বরং ঘরের কাজে নারীর পাশাপাশি পুরুষকে সমান সহযোগী হওয়ার উপদেশ দিতে পারতেন। আরও বলতে পারতেন, জামায়াত ক্ষমতায় এলে মানসম্মত ডে-কেয়ার সেন্টার বাড়াবে, বাধ্যতামূলক মাতৃত্বকালীন ছুটির পাশাপাশি পিতৃত্বকালীন ছুটি দেবে এবং নারী-পুরুষ উভয়ের পেশাগত ও পরিবারিক জীবনের জন্য এক ভারসাম্যপূর্ণ কর্মপরিবেশ সৃষ্টি করবে।
সর্বোপরি, নারীর ক্ষমতায়ন মানে তাঁকে ‘কম কাজ’ করার কথা বলা নয়, বরং তাঁর নিজের সময় ও জীবনের ওপর নিজস্ব সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দেওয়া। একটি সত্যিকারের অগ্রসরমাণ সমাজ নারীর কাজের ঘণ্টা কমায় না, তাঁর সম্ভাবনার পরিধি বাড়ায়। তাই পাঁচ ঘণ্টার সহমর্মিতা নয়, আমাদের দরকার সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বিকাশের সমান সুযোগ ও অধিকার।
লেখক: আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক