হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

আমরা সবাই পাগল হলে কেমন হয়

স্বপ্না রেজা

হুমায়ূন আহমেদ ও মেহের আফরোজ শাওনের ছেলে নিষাদ হুমায়ূনের একটা ভাইরাল ভিডিও ক্লিপ দেখলাম। বেশ মজা পেলাম। সত্যি বললে মজার চেয়েও ছোট্ট বাচ্চার কথায় ভাবনার উদ্রেক হলো। চিন্তার দুয়ার উন্মুক্ত হলো।

তার কথায় বুঝলাম, সাধারণত পাগলেরাই সত্যকে খুঁজে বের করে ও করার চেষ্টা করে, ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে এবং একসময় সত্যটা পেয়ে যায়। উদাহরণও সে বলে যে স্যার আইজ্যাক নিউটনের মাথায় আপেল পড়লে তিনি কিন্তু মাথায় হাত দিয়ে বিষয়টি আর সবার মতো ঝেড়ে ফেলে দেননি। উপরন্তু নিউটন বুঝতে চেয়েছেন, জানতে চেয়েছেন যে কেন তাঁর মাথার ওপর আপেল পড়ল। এই রহস্য বা কারণ তিনি সারা জীবন খুঁজেছেন এবং এর বিনিময়ে তিনি পেয়েছেন ফিজিকসের মতো এক মহাবিদ্যা। নিউটনের মাথার ওপর আপেল না পড়লে হয়তো তিনি এই পড়া নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। আর ফিজিকসের মতো এক মহাবিদ্যার সঙ্গে মানুষের পরিচয় ঘটত না।

আপেল পড়াতে তিনি তাঁর কারণ অনুসন্ধান করেছেন—বিষয়টি সত্য যেমন, তেমন সত্য অনেকের কাছে বিষয়টি হাস্যরসের কারণও ছিল বটে। যারা হেসেছে তারা ভেবেছে, মানুষটা নির্ঘাত এক মহাপাগল! গাছ থেকে একটা আপেল পড়লে সেটা নিয়ে এত ভাবাভাবির কী আছে! নিউটন সত্যি আর দশজনের মতন সাধারণ কেউ ছিলেন না। তিনি অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন, অস্বাভাবিক মেধা আর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। যে বিজ্ঞান আজও মানবজাতির অধ্যয়নের মূল পাঠ্য হয়ে আছে, তার নেপথ্যে অন্যতম একজন নিউটন। সম্ভবত সেই কারণেই তাঁকে আলাদা করা সহজ, পাগল বলা যায়!

প্রাকৃতিক নিয়মে বিশ্বপরিমণ্ডলে যা ঘটে, ঘটছে সেই সম্পর্কে মানুষের একটা সাধারণ ধারণা দাঁড়িয়ে গেছে ইতিমধ্যে বেশ কিছু পাগলের অতি রহস্য অনুসন্ধানী মন ও বুদ্ধিমত্তার কারণে। ফলে কেন, কী কারণে কী ঘটে, মানুষ তা আন্দাজ করতে পারে, বলতে পারে এবং বলতে শিখেছে। নিজেদের সুরক্ষিত করতে শিখেছে। প্রতিরোধ বিষয়ে সক্ষমতা অর্জন করেছে। পরিকল্পনা নির্ধারণ, অস্তিত্ব টেকানো, উন্নয়নের মতো বিষয়গুলো সহজ হতে সহায়তা করেছে। সভ্যতার বিকাশ, প্রসার ও মানবজাতির আচার-আচরণের যে ক্রমবর্ধমান আধুনিকতা, সহজীকরণ—সবকিছুর পেছনে বেশ কিছু পাগল ও মহাপাগলের অবদান আছে। এমন ধারণা অর্জন, জ্ঞান লাভের জন্য হুমায়ূন আহমেদের সন্তানের মতো বলা যায়, পাগলের দরকার আছে!

সাধারণত সমাজের যে মানুষগুলো পথেঘাটে উদ্‌ভ্রান্ত, উন্মাদনায় হাঁটাচলা করে, অস্বাভাবিক আচরণ করে, তাদের আমরা পাগল বলে থাকি। বলতে ও ভাবতে ভালোবাসি। কৌতূহল ও অতি উন্নাসিকতায় বলে উঠি, ‘ওই যে রাস্তা দিয়ে পাগল যায়!’ ঢিল ছুড়ে মজাও নিতে দেখা যায় কাউকে কাউকে। আবার নানান ধরনের মানসিক সমস্যা ও বৈকল্যের শিকারগ্রস্তদের পাগল বলতে আমরা অভ্যস্ত ও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। সমাজে বিদ্যমান, প্রচলিত বিধিনিয়ম ও অসংগতিমূলক আচরণ, ঠুনকো মূল্যবোধ তেমনই বলতে ও বুঝতে শিখিয়েছে। ফলে অর্থহীন কথাকে গুরুত্ব দেওয়া আবার মূল্যবান কথাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভালো মানুষকে মন্দ মানুষ বলা, শিক্ষিত ও বুদ্ধিমানকে অশিক্ষিত বলে গালিগালাজ করার মতো অবিবেকী আচরণেরও বেশ প্রচলন ঘটেছে।

ছোট্ট শিশু যেভাবে পাগলের সংজ্ঞা তুলে ধরল এবং বাবাকে ও নিজেকে পাগল দাবি করল, তাতে পাগল সম্পর্কে প্রচলিত ধারণার যেমন ইতি টানা সম্ভব, ঠিক তেমনই পাগল সম্বোধনকে অতি উচ্চতর মর্যাদায় নিয়ে যাওয়া যায়। বলতে দ্বিধা নেই যে তার কথা শুনে আমার নিজেকেও পাগল ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমি কেন নিজেকে পাগল ভাবব কিংবা ভাবার কথা ভাবছি? কারণ তো আছেই। প্রথমত, আমি আমার দেশকে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতায় তথা নির্দলীয়ভাবে ভালোবাসি।

এই ভালোবাসার পেছনে এমন কোনো স্বার্থ নেই যে ব্যক্তিগতভাবে আমি সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হব বা হতে পারি। সাধারণত দেশের কথা, দশের কথা বলতে বলতে যাঁরা রাতদিন আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে চলেন, মুখে ফেনা তোলেন—এসবের পেছনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের নির্দিষ্ট অ্যাজেন্ডা থাকে। তাঁরা অ্যাজেন্ডা নিয়ে চলেন যেখানে ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বার্থপরতা মুখ্য থাকে, সমষ্টির নয়। বলতে দ্বিধা নেই যে এমন সুবিধাবাদীর সংখ্যা অগুনতিতে পৌঁছে যাচ্ছে দিন দিন। দেশকে স্বার্থ ছাড়া ভালোবাসা যেন অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। কখনোসখনো কোনো ঘটনায় কোনো ব্যক্তিকে নিঃস্বার্থপর মনে হলেও পরক্ষণেই তার স্বার্থপর চেহারাটা দৃশ্যমান হয় তারই আচরণে। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে পাগল মনে হওয়ার কারণ হলো চিন্তা, চেতনায়

ও কাজে দেশকে ভালোবাসার পেছনে ব্যক্তি আমার কোনো স্বার্থ ছিল না, আজও নেই। দেশকে ভালোবাসার বিষয়টা যেখানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাণিজ্যে রূপান্তর করা হয়েছে, সেখান থেকে দূরে থাকাটা এক মহাপাগলামি তো বটেই।

দ্বিতীয়ত, একবারও মনে হয়নি সত্যকে মিথ্যার আবরণ দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে দুই কলম লিখে সুবিধাভোগী হয়ে উঠি। অনেকে দুর্বলতার কথা বলে, দুর্বলতার কাঁধে ভর করে ক্ষমতায় গিয়ে বসি, ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করি। মাঝেসাঝে অনেকেই জানতে চায়, দেশের কথা এত ভেবে, লিখে আমার কী লাভ? কেনইবা লিখি? বোধ যেখানে গভীর ও অসীম, সেখানে অল্প কথায় জবাব দেওয়া বোকামি। আমি জবাব না দিয়ে নিজেকে পাগল ভাবি। সেটাই উত্তম।

তৃতীয়ত, যেকোনো কাজ সম্পন্ন হতে সমাজে অর্থনৈতিক লেনদেন বহুল প্রচলিত একটা রীতিনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে আমি বিপরীত ধারায় প্রবহমান। কাজ সম্পাদনে অপচর্চাকে প্রশ্রয় দেওয়ার কথা ঘুণাক্ষরেও মাথায় আসে না। ফলে অনেক জায়গায় বেমানান হতে হয়। সেই অর্থে আমি একজন ভয়ংকর পাগল। আবার তেল দিয়ে পদ-পদবি ও সুবিধাভোগের সংস্কৃতিতে আমি বরাবরই অচল মুদ্রা হয়ে থেকেছি। যাহোক, এককথায় বলা যায় যে যাবতীয় অসংগতির বিপরীতে অবস্থান করা ব্যক্তির একধরনের পাগলামি। এ ধরনের ব্যক্তিদের পাগল বলা যায় হুমায়ূনপুত্রের কথার সূত্রে।

ক্ষমতার প্রতি মোহ, কেবল নিজেকে সুরক্ষিত করার বিরতিহীন প্রবণতা, দোষারোপের সংস্কৃতি, প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধপরায়ণতা, মানুষকে সম্মোহন করে তার দুর্বল জায়গাকে পুঁজি করা ইত্যাদি নেতিবাচক মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির সয়লাব সমাজে। এসব আচরণ দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে দিন দিন।

এই সবই সামাজিক ও রাজনৈতিক রীতিনীতিতে পরিণত হয়েছে। ফলে এর বিপরীতে শূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে। কেউ স্বেচ্ছায় বিপরীতে অবস্থান নেয় না। অবস্থান নিতে শঙ্কিত বোধ করে, ভয় পায়। এই ভিতুরা পাগলবেশেই থাকে।

পাগল হয়েই বাঁচে। পরিশেষে একটা কথা না বললেই নয়। প্রতিটি ব্যক্তি যতটা না তার বিচারবুদ্ধিতে চলে, বুঝতে পারে কোনটা ভালো বা কোনটা মন্দ, যখন কেউ বা অন্যরা তাকে বা তাদের ওপর ভিন্ন চেতনা আরোপের চেষ্টা করে, বুঝ দিতে মরিয়া হয়, তখন ফলাফল যা হয় তা অত্যন্ত জটিল। এই জটিলতা সহজ-সরল মানুষ আর খণ্ডন করতে পারার ক্ষমতা রাখে না। একজন নিউটন তাঁর মেধা, অনুসন্ধানী মন নিয়ে আপেল পড়ার রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে সমর্থ হয়েছিলেন সম্পূর্ণভাবে একনিষ্ঠ সাধনা, গবেষণা দিয়ে। তথ্য, উপাত্ত ও বিষয়ের প্রতি তাঁর মনোনিবেশ ও নিরপেক্ষতা মজবুত ও শক্তিশালী ছিল বলেই তিনি আপেল পড়ার কারণ উদ্‌ঘাটন করতে পেরেছেন। এবং সবাইকে তিনি সেই বিষয়ে অবহিত করতে সমর্থ হয়েছেন। পৃথিবীতে যুগে যুগে এমন অনেক রহস্য উদ্‌ঘাটন করে অনেক তত্ত্ব ও সূত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, যা মানবজাতিকে এগিয়ে দিয়েছে, এগিয়ে নিয়েছে। আমরা কি সবাই সেই পথে এগোতে পারি না, সবাই পাগল হতে পারি না? পারি তো!

স্বপ্না রেজা, কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

সংকটেও ভালো থাকুক বাংলাদেশ

মন্ত্রীদের বেতন-ভাতা নিয়ে কথা

পাঠকের লেখা: বিজয় অর্জনের গৌরব

নিরাপত্তাহীনতা

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের কি বিচ্ছেদ হলো

একাত্তরে সামষ্টিক মুক্তি আসেনি

আজ বিজয়ের দিন

অসময়েই শত্রু-মিত্র, মীরজাফর ও বিশ্বাসঘাতককে চেনা যায়

খেলা কি তবে এবার মুখ ও মুখোশের

রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতারণা