পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে ঢাকার ছোট চায়ের দোকান ছেড়ে উন্নত জীবনের আশায় ২০২২ সালে মালয়েশিয়ার পথে পা বাড়ান কুমিল্লার চান্দিনার যুবক আকাশ। পরিবারকে একটু স্বস্তি দিতে শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে দেশে-বিদেশে দালালদের টাকা পরিশোধ করে বিদেশে গেলেও সেখানে গিয়ে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল ভয়াবহ বাস্তবতা।
মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর পর আকাশ বুঝতে পারেন, যে বেতনের কথা বলা হয়েছিল, এর সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। যেখানে খেয়ে-পরে টিকে থাকা কঠিন, সেখানে সঞ্চয়ের তো প্রশ্নই আসে না। ঢাকায় তাঁর আগের চায়ের দোকান থেকেও কম আয় হয় সেখানে। কয়েক মাসের মধ্যে বুঝে যান, বিদেশে আসা ছিল জীবনের বড় ভুল। নিজের সঙ্গে বিপদে ফেলেছেন পরিবারকেও।
অবশেষে ২০২৩ সালে দেশে ফিরে কমলাপুর ফুটপাতে আবার শুরু করেন চায়ের দোকান। দুই বছরে ধারদেনা শোধ করেছেন, তবে বাবার জমিটা উদ্ধার করতে পারেননি।
আকাশ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় যাওয়াই ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে ভুল সিদ্ধান্ত। আমরা কয়েকজন একসঙ্গেই দেশে ফিরে এসেছি। আর কখনো বিদেশে যেতে চাই না।’
সম্প্রতি মালয়েশিয়াগামী শ্রমিকদের নিয়ে একটি জরিপ শুরু করেছে দেশের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ নিয়ে তদন্তে নেমেছে। এতে ৬০টি রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে নতুন করে অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি উঠে এসেছে।
দুদকের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে মোট ২ লাখ ৬৭ হাজার ২৭৬ জন শ্রমিকের কাছ থেকে অতিরিক্ত ৪ হাজার ৫৪৫ কোটি ২০ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে দালাল চক্র। এই অর্থ আত্মসাৎ করেছে দেশের ৬০টি রিক্রুটিং এজেন্সি। এসব এজেন্সির ১২৪ জনের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগও পেয়েছে দুদক।
এই চার বছরে ১০০ এজেন্সির বিরুদ্ধে শ্রমিকদের কাছ থেকে নির্ধারিত ফির চেয়ে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো শ্রমিকদের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছে ৭ হাজার ৯৮৪ কোটি ১৫ লাখ ৭ হাজার ৫০০ টাকা। এজেন্সিগুলোর ২৩২ জন দায়িত্বশীল ব্যক্তির বিরুদ্ধে টাকা আদায়ের সুস্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থা।
দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে এসব অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের নাম। এর মধ্যে কয়েকটি হলো—জনতা ট্রাভেলস লিমিটেড, ত্রিবেনী ইন্টারন্যাশনাল, এমএস সান ওভারসিজ, কিসওয়া এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, নাতাশা ওভারসিজ, রমনা এয়ার ইন্টারন্যাশনাল, উইন ইন্টারন্যাশনাল, মৃধা ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশন, প্রান্তিক ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম লিমিটেড, সুলতান ওভারসিজ ও প্রভাতী ইন্টারন্যাশনাল।
দুদকের একটি সূত্র জানায়, প্রবাসী শ্রমিকদের রক্ত-ঘামে উপার্জন করা টাকা বহু বছর ধরে হাতিয়ে নিচ্ছিল এ চক্র। তদন্ত শেষে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
উল্লেখ্য, বিভিন্ন অনিয়ম ও সিন্ডিকেটের কারণে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করেছিল মালয়েশিয়া। পরে ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর দেশটি পুনরায় বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়ার চুক্তি করে। তখন শ্রমিক ভিসায় যেতে সর্বোচ্চ ৭৮ হাজার ৫৪০ টাকা ফি নির্ধারণ করে সরকার, যা ২০২২ সালে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অফিস আদেশের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত খরচের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি অর্থ আদায় করেছে।