কথায় বলে, ‘যে পরিবেশে থেকে অসুস্থ হয়েছেন, সে পরিবেশে থেকে সুস্থ হতে পারবেন না। হলেও তার গতি হবে ধীর।’ এ কারণেই আগেকার দিনে রোগীদের সুস্থ হওয়ার উপায় হিসেবে ওষুধের পাশাপাশি চিকিৎসকেরা হাওয়া বদলের পরামর্শ দিতেন। তবে অসুখে পড়লে আজকাল আর কেউ বলে না, ‘হাওয়াটা বদলাও, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
প্রকৃতির সান্নিধ্যে গেলে শরীরে অক্সিজেনের সরবরাহ বেড়ে যায়। খোলামেলা পরিবেশে প্রচুর অক্সিজেন থাকে, ফলে শরীর ও মন ভালো হয়। হাওয়া বদলের ফলে সাধারণত ২ থেকে ৩ সপ্তাহের মধ্যেই শরীর আরোগ্য় লাভ করে। সাধারণ অসুখের ক্ষেত্রে যেকোনো চিকিৎসকের কাছে বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়ার চেয়েও ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ বেশি কার্যকর এই হাওয়া বদল। এমনিতে সুস্থ থাকতেও প্রতি ২ থেকে ৩ মাস পরপর হাওয়া বদল করা উচিত। এতে অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা কমে। ডা. তাহরিয়াত আহমেদ শরীফ, সহকারী রেজিস্ট্রার, মেডিসিন বিভাগ, কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল, ঢাকা।
‘হাওয়া বদল’ শব্দ দুটি চমৎকার; কিন্তু বিলুপ্তপ্রায় প্রথা। এটি ছিল একধরনের প্রাচীন চিকিৎসা। আজ থেকে ৬০ বা ৭০ বছর আগেও শারীরিক বা মানসিক সমস্যা যত জটিলই হোক না কেন, চিকিৎসক কোনো ওষুধ দেওয়ার আগে একবার হলেও হাওয়া বদলের পরামর্শ দিতেন।
কারও ঘন ঘন জ্বর আসছে? হাওয়া বদল করুন, সুস্থ হয়ে যাবেন। অরুচি? উপায় একটাই, হাওয়া বদল। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত? চিকিৎসা হাওয়া বদল। অসুখ যেমনই হোক না কেন, এক সপ্তাহ বা এক মাসের জন্য পরিবেশ পরিবর্তনের এ পরামর্শ খুবই জনপ্রিয় ছিল একসময়।
এ ধারণার শুরুটা কোথায়?
উনিশ ও বিশ শতকের প্রথমার্ধে ব্রিটিশরা এ ধারণাটি ভারতবর্ষে নিয়ে আসেন। গ্রীষ্মের গরমে ক্লান্ত ব্রিটিশরা ভারতের ঠান্ডা প্রদেশগুলোতে গিয়ে বিশ্রাম নিতেন এবং সুস্থ হওয়ার চেষ্টা করতেন। জলবায়ু ও পোকামাকড়ের কারণে ভারতের পরিবেশ তাঁদের কাছে কিছুটা অস্বাস্থ্যকর ঠেকত। তাই তাঁরা এই হাওয়া বদলকে একধরনের নিরাময় ও মৌসুমি রোগবালাই থেকে সুস্থ থাকার উপায় হিসেবে দেখতেন। ধীরে ধীরে এ প্রথা স্থানীয়দের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে এবং বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে।
হাওয়া বদল কীভাবে কাজ করে
হাওয়া বদল আসলে দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি থেকে ছুটি দেয়। নতুন গন্তব্যে গিয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে মানুষ মুক্তির স্বাদ খুঁজে পায়, পায় একধরনের আরাম। চারপাশে খোলামেলা আকাশ, সবুজ প্রকৃতি, মুক্ত বাতাস, সঙ্গে পাহাড়, সমুদ্র কিংবা অবারিত নৈঃশব্দ্য—এ সবকিছু মানুষকে মুগ্ধ করে। পরিচিত গণ্ডির বাইরে কোলাহলমুক্ত জায়গায় মানুষ জীবন নতুনভাবে দেখতে ও বুঝতে শেখার সময় পায়। একই আকাশ, কিন্তু তার রং যেন মনে হয় আরও সুন্দর হয়ে ওঠে। সবকিছুই ভিন্ন রঙে ধরা দিতে শুরু করে।
এ পরিবর্তনটাই মনকে সতেজ করে তোলে, মানুষ ইতিবাচক দৃষ্টিতে আবার জীবন দেখার সুযোগ পায়। শরীরে ভালো হরমোন নিঃসৃত হতে থাকে। ফলে ধীরে ধীরে রোগমুক্তি হয়; কিংবা তার প্রকোপ কমে যায়। এই ‘হাওয়া বদল’ কেবল যে শারীরিক অবসাদ ও ক্লান্তি দূর করে, তা-ই নয়। এটি মানসিক চাপ থেকেও দেয় মুক্তি। এটি শরীর ও মন দুয়ের জন্যই থেরাপি হিসেবে কাজ করে।
হাওয়া বদলের চল কেন হারিয়ে গেল?
আকাশছোঁয়া খরচ
আগে হাওয়া বদল করা অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। সবারই দূরে দূরে আত্মীয়স্বজন থাকত। দীর্ঘ সময় পর বেড়াতে যাওয়া মানুষদের আন্তরিকভাবে বরণ করত তারা। এমনকি যারা বাংলোয়, নিজেদের অন্য বাড়িতে বা পরিচিত কারও বাড়িতে উঠত, তাদের জন্যও যাতায়াত, থাকা-খাওয়ার খরচ এত আকাশছোঁয়া ছিল না। মানুষ চাইলেই দূরে কোনো জায়গায় গিয়ে কিছুদিন কাটিয়ে আসতে পারত। কিন্তু এখন হাওয়া বদল করতে গেলে থাকা-খাওয়া বাবদ বেশ মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ হয়ে যায়, যা অনেকের পক্ষেই বহন করা কঠিন।
সময়ের অভাব
এখন মানুষ এতটাই ব্যস্ত ও আধুনিক; যে তাদের কাছে হাওয়া বদল নিছকই ছেলেমানুষি। এখন আধুনিক মানুষের অর্থ থাকলেও সময় নেই। টানা এক সপ্তাহের ছুটি মেলাও অনেকের কাছে দুরূহ ব্যাপার।
ম্যাজিক পিলের খোঁজ
বর্তমানে সবকিছুর জন্যই চাই সহজ ও দ্রুত সমাধান বা ম্যাজিক পোশন। চিকিৎসকের ওষুধেই সুস্থ হতে হবে—এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তা নিয়ে ভাববার সময় নেই। প্রাকৃতিক নিরাময়কে এখনকার মানুষ ধীরগতির বলেই মনে করছে। বিজ্ঞানও তাই দ্রুত ব্যথা কমানো আর জীবাণু ধ্বংসকারী ওষুধ নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে। ফলে মাত্র ৫ মিনিটে ব্যথা নিরাময় আর ৩ থেকে ৫ দিনে মৌসুমি অসুখ সেরে যাচ্ছে। ফলে হাওয়া বদল হয়ে উঠেছে প্রাচীন প্রথা। হয়ে গেছে বিলুপ্ত।
সূত্র: দ্য পয়েন্টিং ম্যাগ ডটকম