‘গোলাপি শহর’, ‘হ্রদের শহর’, ‘মসজিদের শহর’ ইত্যাদি বিভিন্ন নামে ডাকা হয় পৃথিবীর বিভিন্ন শহরকে। কিন্তু বিড়ালের শহর? না, এখনো এমন নামে ডাকা না হলেও মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে সেই শহরে থাকে প্রায় আড়াই লাখ বিড়াল! এ কারণে কি শহরটিকে বিড়ালের শহর নামে ডাকা যাবে?
ইউরোপ ও এশিয়ার সংযোগস্থল এবং বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত শহর ইস্তাম্বুল। এই শহরে বাস করে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষ। আর এখানেই মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে বসবাস করে প্রায় আড়াই লাখ বিড়াল! তারাও শহরবাসীর দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে।
শহরের রাস্তায়, মসজিদের প্রাঙ্গণে, মেট্রো স্টেশনে কিংবা কফিশপে এই বিড়ালদের সহজে দেখা যায়। তারা মানুষের সঙ্গেই মিলেমিশে থাকে। রাস্তায় খায়, সেখানেই ঘুমায় আর কখনো পর্যটক বা স্থানীয়দের সঙ্গে খেলায় মেতে ওঠে। ‘সিটি ক্যাটস অব ইস্তাম্বুল’ বইয়ের লেখক মার্সেল হেইনজেন বলেন, ইস্তাম্বুলের বিড়ালেরা সাধারণ পোষ্য নয়, কিন্তু রাস্তার বিড়ালও নয়। তারা মানুষের সঙ্গে সহাবস্থানে থাকে এবং শহরবাসীদের সবাই তাদের যত্ন নেয়। তারাও মানুষের মতো শহরের অংশ।
ইতিহাসের ছোঁয়া
ইস্তাম্বুলের বিড়ালদের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নতুন নয়। ইস্তাম্বুলের ক্যাট মিউজিয়ামের সহপ্রতিষ্ঠাতা ফাতিহ দাগলি বলেন, ওসমানি যুগে এ শহরের মানুষের মধ্যে রাস্তার বিড়ালদের প্রতি গভীর মমতা দেখা যেত। তখন তাদের খাওয়ানো অনেকের পেশা ছিল। স্থানীয়রা নিজে খাবার কিনে দেওয়া বা ম্যানকাজিদের মাধ্যমে বিড়ালদের খাওয়াত।
দাগলি আরও বলেন, ফিনিশীয়রা জাহাজে বিড়াল রাখত ইঁদুর দমন করার জন্য। রোমান ও ওসমানি যুগে যখন বাণিজ্যিক জাহাজগুলো ইস্তাম্বুলে আসে, তখনো তারা বিড়ালদের সঙ্গে নিয়ে আসত।
নগরে সহাবস্থান
আজও মানুষদের সঙ্গে ইস্তাম্বুল শহরের অংশ এই বিড়ালেরা। রাস্তা, বাজার, কফিশপ—সব জায়গায় তাদের দেখা যায়। বেঞ্চে বসে শহর দেখতে দেখতে কিংবা বসফরাসের তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেক পর্যটক এই বিড়ালদের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করেন, তাদের সঙ্গে খেলেন।
হেইনজেন বলেন, শহর সাধারণত কংক্রিট, ইট, রাস্তাঘাট, বড় বড় ভবন আর ব্রিজ দিয়ে তৈরি। সেখানে কোনো প্রাণীর জন্য সহজ বা স্বাভাবিক থাকার ব্যবস্থা থাকে না। কিন্তু ইস্তাম্বুলে শহরের মাঝখানেও বিড়ালেরা সুন্দর বাস করছে। শহরের মানুষও তাদের ব্যাপারে বেশ যত্নবান। স্থানীয়রা তাদের খাওয়ায়, চিকিৎসায় সাহায্য করে।
মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব
ইস্তাম্বুলের বিড়ালেরা শুধু শহরের অংশ নয়, তারা মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বও গড়ে তুলেছে। বাজার, মেট্রো স্টেশন বা কফিশপের বাইরে খাবারের বাটি ও পানি রাখা থাকে তাদের জন্য। স্থানীয়রা নিজের খাবারের অংশ ভাগ করে দেয় বিড়ালদের। অনেক দোকানেও এদের দেখতে পাওয়া যায়। পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন সময় তারা বিড়াল পোষে। শহরের ঐতিহাসিক এলাকায়, যেমন ফাতিহ, ব্লু মসজিদ বা হাগিয়া সোফিয়ার আশপাশে এদের বেশি দেখা যায়। কিছু বেড়াল পর্যটকদের ছবিতে পোজ দেয়।
ক্যাটেস্তাম্বুলের শিক্ষণীয় দিক
ইস্তাম্বুলের বিড়ালেরা শুধু শহরের অংশ, এমন নয়। তারা মানুষের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের এক দারুণ উদাহরণ। শহরের ব্যস্ততা, যানজট, রাস্তাঘাট, কংক্রিটের বিশাল ভবন সবকিছু মিলিয়ে শহরটি সব সময় ব্যস্ত। তবু এই ছোট প্রাণীরা শহরটিতে তাদের জায়গা করে নিয়েছে। স্থানীয়দের যত্ন বিড়ালদের জীবনকে নিরাপদ ও আনন্দময় করে তুলেছে। শহরের হঠাৎ হুড়োহুড়ি, ভিড় ও শব্দের মধ্যে এই ছোট প্রাণীরা শান্তি নিয়ে আসে।
বিশ্বজুড়ে অনেকেই বিড়াল পোষে। বিভিন্ন প্রজাতির বিড়াল দেখা যায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। কিন্তু একটি শহরের রাস্তায় প্রায় আড়াই লাখ বিড়ালের এমন পরিবার অনন্য এক উদাহরণ। এই পৃথিবী যে সব প্রাণীর জন্য, তার এক অনন্য উদাহরণ ইস্তাম্বুল।
ইস্তাম্বুলের মতো বিশাল নগরীতেও ভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে স্থান, খাদ্য ও জীবন ভাগ করে নেওয়া সম্ভব। এই ‘ক্যাটেস্তাম্বুল’ বিশ্বের কাছে এক সুন্দর বার্তা বহন করে। মানবতা কোনো সীমানা বা প্রজাতি মানে না। ভালোবাসা ও যত্নের মাধ্যমে একটি শহর সত্যিকার অর্থেই প্রাণবন্ত এবং মানবিক হয়ে উঠতে পারে।
সূত্র: বিবিসি