বিশ্বকবির রুপালি চুল দেখে কখনো এর চাকচিক্য়ের কারণ জানতে মন চায়নি? শুরুতেই বলে রাখা ভালো, কবিগুরু লেখার খাতায় মন ডুবিয়ে রাখলেও নিজের যত্নের ব্যাপারে কিন্তু মোটেই আত্মভোলা ছিলেন না। প্রমথ চৌধুরী রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমি এর পূর্বে রবীন্দ্রনাথের মতো সুপুরুষ কখনো দেখিনি।’
কবির অন্যতম ব্যক্তিগত চিকিৎসক পশুপতি ভট্টাচার্য রবীন্দ্রনাথের কাছে একবার তাঁর চকচকে রেশমের মতো চুলের রহস্যের কথা জানতে চেয়েছিলেন। কবি উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমি তেলও মাখি না, পারতপক্ষে সাবানও মাখি না, তেল দিলে চুলে জট পাকায়, আর সাবানে রুক্ষ হয়ে যায়। আমি চুলে মাখি সর্ষে বাটা।’
আমেরিকায় থাকাকালে তিনি শ্যাম্পু করতেন। তাতে কবির চুল খুব সুন্দর থাকত। কিন্তু দেশে ফিরে আর সেসব জিনিস কি পাওয়া যায়? তাই নিজের চুলের জন্য নিজেই প্রাকৃতিক উপাদানে এই শ্যাম্পু তৈরি করে নিয়েছিলেন। রোজ আধা বাটা করা সর্ষে কবির জন্য রাখা থাকত। এই সর্ষেবাটা তিনি ডালবাটার সঙ্গে মিশিয়ে গায়েও মাখতেন। এতে তাঁর চুল ও ত্বক দুটোই মসৃণ থাকত।
অনেক পরে এসে অবশ্য কবি সাবান ব্যবহার করতে শুরু করেন। সেই সাবানের জোগান দিতেন ডা. পশুপতি ভট্টাচার্যের ভাই বিজ্ঞানী গিরিজাপতি ভট্টাচার্য।
ঠাকুরবাড়িতে নারী-পুরুষ বলতে গেলে প্রত্যেকেই রূপটান মেখে স্নান করতেন। ছোটবেলায় মা সারদা দেবী বাদামবাটা, দুধের সর ও কমলালেবুর খোসাবাটা মিশিয়ে কবির গায়ে মাখিয়ে দিতেন। এরপরই স্নান করতে পারতেন রবীন্দ্রনাথ।
ঠাকুরবাড়ির মেয়ে-বউয়েরা নাকি দিনে অন্তত একবার দুধের সর আর ময়দার মিশ্রণ তৈরি করে সারা শরীরে মাখতেন। এরপর কিছুক্ষণ তা ত্বকে মালিশ করে গামছা দিয়ে ঘষে ঘষে ধুয়ে নিতেন। সর-ময়দার এই মিশ্রণ তাঁদের ত্বকের রং উন্নত করত, অতিরিক্ত লোম অপসারণ করত এবং ত্বক রাখত মসৃণ। এ ছাড়া ত্বকের ময়লা কাটাতে ও রোদে পোড়া দাগ তুলতে ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা মসুর ডালবাটার সঙ্গে কমলালেবুর খোসাবাটা মিশিয়ে ত্বকে ব্যবহার করতেন।
ওই সময় ঠাকুরবাড়িতে সাবানের পরিবর্তে বেসন ব্যবহারের চল ছিল। তবে সময় বিশেষে গ্লিসারিন সাবান ব্যবহার করতেন তাঁরা। স্নানের পর ত্বকে ব্যবহারের জন্য ক্রিম তৈরি হতো বাড়িতেই। ‘মোম রুট’ নামের সেই ক্রিম তৈরির জন্য আনা হতো মৌচাকের মোম। এই মোম গুঁড়ো করে তার সঙ্গে মেশানো হতো নারকেল তেল। তাতে মিহি যে মিশ্রণ তৈরি হতো তা কৌটোয় সংরক্ষণ করা হতো। সারা বছর এই ক্রিম ঠাকুরবাড়ির সদস্যরা ত্বকে ব্যবহার করতেন।
সে সময় তো ভ্রমণ শেষে বাড়ি ফিরে ত্বকের যত্ন নিতে স্যালনে যাওয়ার উপায় ছিল না। তাই সমুদ্র বা পাহাড় থেকে ঘুরে আসার পর ত্বকের রোদে পোড়া দাগ তুলতে আটার প্রলেপ লাগিয়ে আলতো করে ঘষতেন তাঁরা। কয়েক দিনের মধ্য়েই ত্বকের স্বাভাবিক রং ফিরে আসত।
ত্বকে বসন্ত ও ব্রণের দাগ বসে গেলে পাতলা কাপড় ডাবের পানিতে ভিজিয়ে দাগের ওপর বুলিয়ে নিতেন। এতে দাগ হালকা হতো।
এর বাইরেও সপ্তাহে একদিন বাড়িতে নাপতানি আসত। অন্দরের নারীদের পেডিকিওর-মেনিকিউর করে দিতে। পা ঝামা দিয়ে ঘষে ভালো করে ধুয়ে পরিয়ে দিত আলতা। সেই আলতা আবার বোতলজাত নয়। আলতা পাতা ছিঁড়ে রস বের করে তা দিয়েই রাঙানো হতো পা। নখ রাঙানো হতো মেহদির রঙে।
সূত্র: ঠাকুরবাড়ির রূপ-কথা, শান্তা শ্রীমানী