গোলাপি পদ্মফুল ছুঁয়ে আচমকাই ভোমরা যেন প্রাণ ফিরে পেল। চারদিকে সুনসান নীরবতা। আর এর মধ্যে এক কলকল নদীর স্রোতের মতো ধেয়ে আসে পৌষের বাতাস, উড়িয়ে দিতে চায় সেই সুদর্শন ভোমরাকে। ভোমরার অবশ্য আজ কোথাও যাওয়ার নেই, শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে পদ্মকে তাই। সে গোলাপি পদ্ম ফুটেছে রাজবাড়ির মন্দিরের সাদা দেয়ালে। লতায় পাতায়, মোটিফে, অলংকরণে ঢেকে দিতে চাইছে মন্দিরের দেয়াল। মন্দির তো অনেক দেখেছি কিন্তু এমন মন্দিরও কি জগতে আছে, যার পদ্মকে আঁকড়ে ধরে থাকে তারই প্রাণভোমরা! দিনাজপুরের রাজবাড়ি বলতে এখন আর কিছুই নেই। মন্দিরই সকল দৃষ্টি বিনিময়ের মাধ্যম। কিন্তু এমন অনন্যসাধারণ মন্দির কী করে চুপচাপ এক কোণে দাঁড়িয়ে জপ করে কারও নাম দিবানিশি, সে বিস্ময় আমার আজও কাটে না।
এ জায়গাটা এখনো নীরব; হয়তোবা সব সময়ই নীরবে কথা কয় এক পুজোর সময় ছাড়া। মূল প্রবেশদ্বার এক সময় ছিল রাজবাড়ির প্রবেশদ্বার। সাদা রঙের সাধারণ তোরণ এখন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। এর খানিক ভেতরে সিংহদ্বার। তোরণের মাথায় সিংহ দাঁড়িয়ে। দ্বার পেরিয়ে ভেতরে বাঁয়ে মূল মন্দির, যেখানে আমি প্রাণভোমরার দেখা পেয়েছি। মন্দিরের প্রবেশদ্বারে ঐশ্বর্যের ছড়াছড়ি। বিশাল তোরণ যেন রাজার প্রাসাদের চিত্র এঁকে যায়, নানা রং আর নকশা, কারুকাজ। কাঠের দরজায় সূক্ষ্ম খোদাই। ভেতরে লক্ষ্মী বধূর মতো সাদার ওপরে গোলাপি ফুল লতা পাতার মোটিফের মন্দির মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। আমি তো এই কথাই বলতে এসেছি, ‘প্রাণভোমরা এল বলে।’ সে তখনো লাজুক, নির্বাক, বিনীত। আমি সামনে যাই, রূপ দেখি। পাশ দিয়ে চলি ফিরি, সে কিছুই বলে না।
রাজবাড়ির জিউ মন্দির নির্মিত হয়েছিল আঠারো শতকে। তখন থেকেই পুজোআচ্চা হয়ে আসছে।
রাজা রামনাথের রাজত্বকালে (১৭২২-১৭৬০ সালে) রাজবাড়িতে দুর্গাপূজা আরম্ভ হয়। সাদা দেয়াল, হলুদ, লাল, সবুজ বর্ডার দেওয়া বারান্দার খোলা দরজা, দরজার ওপরে ফুল লতাপাতার মোটিফের নকশা অবধি ঝকঝকে আছে। কিন্তু তার পেছনে তাকালে দেখতে পাওয়া যায় রাজবাড়ির একাংশ জীর্ণ শীর্ণ দশায় করুণ চোখে তাকিয়ে আছে।
সময়টা ছিল ষোলো শতক, জমিদার দিনারাজ ঘোষ গড়ে তুলেছিলেন এই রাজ্যপাট। তাঁর নামেই পরে রাজ্যের নামকরণ হয় দিনারাজপুর এবং ধীরে ধীরে তা হয়ে যায় দিনাজপুর। দিনাজপুর রাজ্য বরাবরই পাঠান, মুঘল ও নবাবদের আক্রমণ পরাস্ত করে জয়ীর বেশে বাংলাদেশের মাটিতে টিকে ছিল।
আরও দু শতক পরের কথা, দিনাজপুরের জমিদার তখন প্রাণ নাথ। অনেকের প্রাণের নাথ বা নাথের প্রাণ! তিনি প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে গেলেন একটা প্রসাদের, একটা তরতর করে ঘটে যাওয়া মূল্যবান শতকের, আর বাংলার সর্ববৃহৎ মহলের। ১৭২২ সাল থেকে তাঁর চল্লিশ বছরের শাসনকালে দিনাজপুর রাজ্য বাংলার প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তিনি ও তাঁর পুত্র রামনাথ উভয়েই বাংলায় বর্গির আক্রমণ সফলভাবে প্রতিহত করেন।
এখন ভগ্নপ্রায় মহলের সাক্ষী হয় ভগ্নহৃদয়। সন্ধ্যায় নিভু নিভু আলোয় হাতড়ে বেড়াতে থাকি দিনারাজের আয়নামহল, প্রাণনাথের রানিমহল। এক ঠাকুরবাড়ি করছে ঝকঝক। বাকিরা বাকরুদ্ধ। এরা কাঁদে, বলতে চায় ঠিক কোন কোণে জমিদারের মন দুলে উঠেছিল কারও হাসিতে বা কোথায় চলতে গিয়ে বিঁধেছিল কাঁটা রানির কোমল পায়ে।
আমার তখন সন্ধ্যা, আমার পথেয় নিভু নিভু আলো।
আমার সব খুব কাছের মনে হয়, বাঁ পাশের মহলে দুপুর বেলা গা এলিয়ে বসে থাকত কেউ, শুনত কাহারবা, আর একটু সামনের উঠোনে একবার পা পিছলে পড়ে ছিঁড়ে ফেলেছিল সে রেশমি আঙরাখা। এত স্পষ্ট, এত তীব্র এ জগৎ এখন আমার কাছে!
অথচ এর বুকের মধ্যিখানে ছিল হাজার হাজার আয়নার এক ঘর। রাতে ঝাড়বাতি জ্বললে সে জ্যোতি ঠিকরে পড়ত দেয়ালে দেয়ালে। দোতলা থেকে জমিদার দেখতেন নৃত্যগীত। কখনো জলসা বসত নিচতলার জলসাঘরে।
আমি খুঁজে মরি মহলের আরও গভীরে, এক ভবন থেকে আরেক মজলিশে। বুকের ভেতরে এক শান্ত ডাক, ‘কত দিন পর এলে!’ আধ খাওয়া জঙ্গল পাহারা দেয় যে পাখিটি সে আমার চেনা, উড়ে উড়ে বলে যায়, ‘ওই যে দেখ সবুজ দিঘি, নাইতে গিয়ে হারিয়েছিল নূপুর আর পেছন বাড়ির খাসমহলে সে তখন অপেক্ষায় ছিল কম্পিত হৃৎস্পন্দন নিয়ে।’
একই প্রাঙ্গণে একসময় ছিল আরও কয়েকটি মন্দির, বিশ্রামাগার, পানির ট্যাংক, চিকিৎসালয়, তোষাখানা, কাছারিঘর, বাগান, কুমারের বাড়ি ইত্যাদি।
পরিত্যক্ত পুকুরটি মহলগুলোর পেছন দিকে সবুজ গুল্মলতা গায়ে জড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। পুকুরের শানবাঁধানো ঘাটে তাজা শেওলা চমৎকার রং বিলাচ্ছে। কেউ আসে না এখানে, ভেঙে যাওয়া রাজবাড়ির মতো পুকুরের মন ভাঙে। এ প্রাঙ্গণে আরও দুটো পুকুর আছে বেশ খানিকটা জায়গা পেরোলে।
সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে মহলে মহলে তারা নেমে আসে, আরেকটু রাত বাড়লে রাজ্যের সুখের দিনের গল্প বলতে থাকে। কেউ এখানে না এলেও গল্প বলায় বিরতি নেই এদের।