মাছে-ভাতে বাঙালি—এই যখন পরিচয়, তখন প্রতিদিনের খাবারে মাছের উপস্থিতি না থাকলে যে পরিপূর্ণতা আসে না, সেটা বলাই বাহুল্য। হরেক মাছের বিভিন্ন পদের তরকারি থাকবে, তবেই না খাওয়ার আনন্দ। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খাবারের প্লেট থেকে যেন মাছের উপস্থিতি কিছুটা কমে যাচ্ছে। মাছের জায়গা দখল করে নিচ্ছে মাংস। মাংসের মধ্যে রেডমিটের উপস্থিতিই যেন বেশি।
মাছ ও মাংস খাওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য শরীরে প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করা। মাছ ও মাংস থেকে আমরা প্রথম শ্রেণির প্রোটিন পেয়ে থাকি। তবে প্রোটিনের পাশাপাশি আমরা বেশ কিছু জরুরি পুষ্টির উপাদানও পাই। তাই মাছ ও মাংস দুটোই আমাদের শরীরের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। দুটিরই কিছু ভালো ও কিছু খারাপ দিক আছে।
কোনটা খাব
দুটোই খাব। তবে মাংসের চেয়ে মাছের উপকারিতা একটু বেশি। তাই মাংসের চেয়ে মাছ বেশি খেতে চেষ্টা করাই ভালো।
- রেডমিটের সম্পৃক্ত চর্বির (খারাপ চর্বি) পরিমাণ মাছের চেয়ে অনেক বেশি থাকে। সম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণ বেশি থাকায় এটি হৃদ্রোগের ঝুঁকি তৈরি করে।
- সম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণ বেশি থাকে বলে বেশি মাংস খেলে রক্তে কোলেস্টেরল ও এলডিএলের (দুটোই ব্যাড ফ্যাট) পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে রক্তনালি ও হার্টের ব্লকের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
- অতিরিক্ত মাংস খেলে রক্তের উপকারী ভালো চর্বি বা এইচডিএল পরিমাণে কমে যায়।
- মাংসে ফাইবার কম থাকে, তাই কোষ্ঠকাঠিন্য ও কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
- মাংসে সোডিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকায় রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। ফলে স্ট্রোক ও হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
- মাংস খেলে রক্তের ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ বাড়তে পারে।
তবে রেডমিটে পর্যাপ্ত পরিমাণে জিঙ্ক, সেলেনিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, ভিটামিন বি২, ভিটামিন বি৩, ভিটামিন বি৬ ও ভিটামিন বি১২ পাওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে রক্তস্বল্পতা নিরাময়ে, হাড় ও দাঁতের গঠনে রেডমিট খুব কার্যকরী। তবে সপ্তাহে এক থেকে সর্বোচ্চ দুই দিনের বেশি রেডমিট খাওয়া উচিত নয়।
- মাছে অসম্পৃক্ত চর্বি বা গুড ফ্যাটের পরিমাণ বেশি থাকে।
- পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট বেশি থাকে। এর মধ্যে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
- ইকোসা পেন্টানোয়িক অ্যাসিড ও ডোকোসা হেক্সানোয়িক অ্যাসিড এই দুটি প্রধান ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড শুধু মাছেই পাওয়া যায়।
- ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড রক্তে কোলেস্টেরল ও এলডিএলের পরিমাণ কমায়। ফলে স্ট্রোক ও হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমে।
- রক্তে গুড ফ্যাট বা এইচডিএলের পরিমাণ বৃদ্ধি করে; যা হার্ট ও রক্তনালির ব্লক তৈরিতে বাধা দেয়। হার্ট ও রক্তনালির ব্লক থাকলে তা কমাতে সাহায্য করে।
- ফাইবার বেশি থাকায় কোষ্ঠকাঠিন্য ও কোলন ক্যানাসারের ঝুঁকি কমায়।
- মাছে সোডিয়ামের পরিমাণ কম থাকে, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে স্ট্রোক ও হৃদ্রোগের ঝুঁকিও কমে যায়।
- গবেষণায় প্রমাণিত, যাঁরা নিয়মিত মাছ খান, তাঁদের ডিমেনশিয়া ও আলঝেইমার রোগ হওয়ার ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় অনেক কম থাকে।
হোক ইলিশ বা পাঙাশ, রুই, কাতল কিংবা শোল-প্রতিদিনের খাবারে অবশ্যই কিছু মাছ রাখার অভ্যাস তৈরি করুন। প্রতিদিন খাবারে মাছ রাখলে স্ট্রোক ও হৃদ্রোগের ঝুঁকি ৫০-৭০ শতাংশ কমে যায়। হৃদ্রোগের রোগীদের জন্য মাছ একটি আদর্শ খাবার। অনেকে জানতে চাইতে পারেন যে রেডমিটে কত শতাংশ চর্বি থাকে। এটা আসলে নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। কারণ এটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। শরীরের কোন অংশের মাংস, প্রাণীর বয়স, প্রাণীর খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে মাংসে চর্বির পরিমাণ। তবে গরুর মাংসে গড়ে প্রায় ২২ শতাংশ ফ্যাট থাকতে পারে। যার বড় অংশই খারাপ ফ্যাট। অন্যদিকে মাছে গড়ে ১০ শতাংশ চর্বি থাকে, যার একটা বড় অংশই ভালো ফ্যাট বা উপকারী চর্বি।
লেখক: পুষ্টি কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল