বিজয় মানুষের চিরন্তন স্বপ্ন। এই শব্দের মধ্যে আছে পরিশ্রমের দীপ্তি, ত্যাগের চিহ্ন ও আনন্দের সূর্যোদয়। ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে, বিজয় মানে আত্মতৃপ্তি নয়, বরং বিনয়; উল্লাস নয়, কৃতজ্ঞতা; প্রতিশোধ নয়, ক্ষমা। বিজয় ইসলামে একধরনের আত্মশুদ্ধি, যেখানে মানুষ আল্লাহর সামনে নত হয়ে বলে, ‘আলহামদুলিল্লাহ—সকল প্রশংসা আল্লাহর।’
ইসলামে বিজয়ের ধারণা
মানবসমাজে বিজয়ের অর্থ সাধারণত ক্ষমতা, প্রভাব, জয় বা আধিপত্য। কিন্তু ইসলামে বিজয় হলো আল্লাহর সাহায্যের প্রকাশ। কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘বিজয় তো শুধু আল্লাহর পক্ষ থেকেই।’ (সুরা আনফাল: ১০)। অর্থাৎ মুসলমান বিশ্বাস করে, যখন সে জয়লাভ করে, তখন তা নিজের বীরত্বের নয়, বরং আল্লাহর ইচ্ছা ও রহমতের ফল। সুতরাং ইসলামে বিজয় কখনো অহংকারে শেষ হয় না; বরং শুরু হয় কৃতজ্ঞতায়।
বিজয়ের প্রকৃত অর্থ ইসলামে দুটি স্তরে প্রকাশিত—১. বাহ্যিক বিজয়; যেমন যুদ্ধক্ষেত্র, ন্যায় প্রতিষ্ঠা, অন্যায়ের পরাজয়। ২. অভ্যন্তরীণ বিজয়; যেমন আত্মসংযম, নফসের ওপর জয়, পাপ থেকে বিরত থাকা। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আমরা ছোট জিহাদ থেকে ফিরে এলাম, এখন বড় জিহাদ শুরু হলো নিজের নফসের বিরুদ্ধে।’ অর্থাৎ সত্যিকারের বিজয় হলো, নিজের ভেতরের অন্ধকারকে পরাজিত করা।
মহানবী (সা.)-এর বিজয় উদ্যাপনের রীতি
ইসলামে বিজয় উদ্যাপনের সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে। ইতিহাসে একাধিক যুদ্ধ ও শান্তিচুক্তির মাধ্যমে তিনি আল্লাহর সাহায্যে বিজয় অর্জন করেছেন। কিন্তু প্রতিবারই তাঁর আচরণ ছিল অনন্য।
ক. ফাতহে মক্কা—বিনয়ের মহাগাথা: হিজরি অষ্টম সনে মক্কা বিজয়ের মুহূর্তে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) যখন শহরে প্রবেশ করলেন, তাঁর মাথা উটের কুঁজে নত ছিল। তিনি কোনো সোনার আসনে বসে প্রবেশ করেননি, বরং বলেছিলেন, ‘আজ প্রতিশোধের দিন নয়; আজ ক্ষমার দিন।’ এই বাক্য ইতিহাসে মানবিকতার এক অমর দলিল হয়ে আছে। শত্রুরা যারা তাঁকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল, আজ তারা সবাই তাঁর করুণার কারণে মুক্ত। মহানবী (সা.) ঘোষণা করলেন, ‘তোমরা সবাই মুক্ত।’ বিজয়ের এই দিন ছিল না রক্তের উল্লাসে ভরা; বরং ছিল ক্ষমা, কৃতজ্ঞতা ও আল্লাহর প্রশংসায় পূর্ণ।
খ. বদর ও হুনাইন যুদ্ধের শিক্ষা: বদর ছিল ইসলামের প্রথম সামরিক বিজয়। মহানবী (সা.) সেদিন সারা রাত আল্লাহর দরবারে দোয়া করেছেন, কেঁদেছেন, নামাজে দীর্ঘ কিয়াম করেছেন। তিনি জানতেন, এই বিজয় তাঁর নয়, এটি আল্লাহর অনুগ্রহ।
হুনাইন যুদ্ধে মুসলমানেরা সংখ্যায় বেশি ছিল, কিন্তু কিছু সময়ের জন্য তারা আত্মবিশ্বাসে ভরপুর হয়ে পড়েছিল। কোরআনে আল্লাহ সতর্ক করলেন, ‘যখন তোমরা নিজেদের সংখ্যায় গর্ব করেছিলে, তখন তা তোমাদের কোনো উপকারে আসেনি।’ (সুরা তওবা: ২৫)। এই আয়াত মুসলমানদের মনে করিয়ে দেয়, অহংকার বিজয়কে পরাজয়ে রূপ দিতে পারে।
ইসলামের ইতিহাসে বিজয় উদ্যাপনের উদাহরণ
ক. সালাহউদ্দিন আইয়ুবির জেরুজালেম জয়: ক্রুসেডারদের থেকে জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের পর সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবি শহরে প্রবেশ করলেন; সেখানে ছিল না কোনো যুদ্ধডঙ্কা, ছিল না কোনো প্রতিহিংসা। তিনি গির্জাগুলো রক্ষা করলেন, খ্রিষ্টানদের নিরাপত্তা দিলেন এবং প্রথমেই মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করে নফল নামাজ আদায় করলেন। তাঁর মুখে ছিল একটিই কথা, ‘এই বিজয় আমাদের নয়, আল্লাহর।’
খ. তারিক বিন জিয়াদের স্পেন বিজয়: স্পেনে প্রবেশের আগে তারিক বিন জিয়াদ তাঁর সৈন্যদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘পেছনে সমুদ্র, সামনে শত্রু। আমরা একমাত্র আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল।’ বিজয়ের পর তিনি মসজিদ নির্মাণ করেন, শিক্ষার প্রসার ঘটান, দাস মুক্ত করেন। কোনো রাজকীয় উৎসব নয়, বরং ছিল ইবাদতের উৎসব।
গ. সুলতান মাহমুদ গজনবির হিন্দুস্তান জয়: সুলতান মাহমুদ গজনবি প্রতিবার বিজয়ের পর নিজেকে ‘আল্লাহর এক দাস’ বলতেন, কখনো ‘সম্রাট’ উপাধি নেননি। যুদ্ধলব্ধ সম্পদ তিনি মসজিদ, মাদ্রাসা ও দরিদ্রদের মাঝে বণ্টন করতেন।
বিজয়ের পর সমাজের দায়িত্ব
ইসলামে বিজয়ের পর সমাজে ন্যায়, শান্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিজয় তখনই অর্থবহ, যখন তা দুর্বলদের মুক্তি দেয়, নির্যাতিতদের আশ্রয় দেয়। বিজয় যদি অন্যায় টিকিয়ে রাখে, অত্যাচার বাঁচিয়ে রাখে, তবে তা বিজয় নয়। ইসলামে বিজয় মানে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা, অন্যায়ের অবসান।
আজকের যুগে বিজয় মানে মিডিয়া কভারেজ, আতশবাজি, মিছিল, গান-বাদ্য ও নৃত্যের আসর। অনেক মুসলমানও পশ্চিমা ধাঁচে উৎসব পালন করে। কিন্তু এসব আচরণ ইসলামি সংস্কৃতির পরিপন্থী। ইসলাম শিক্ষা দেয়, বিজয়ের পর যত বড় আনন্দ, তত বড় দায়িত্ব। বিজয়ের পর যদি কেউ গরিবদের খাওয়ায়, নামাজে দীর্ঘ সিজদায় যায়, কোরআন পাঠ করে, দোয়া করে; তবেই সে ইসলামি বিজয় উদ্যাপন করেছে। আজ মুসলমানদের বিজয় শুধু যুদ্ধক্ষেত্রে নয়; তা হতে পারে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনে, শিক্ষায়, বিজ্ঞানে, নৈতিকতায়, মানবসেবায়।
ইসলামে বিজয় মানে উৎসব নয়, আত্মসমর্পণ। এটি এক আধ্যাত্মিক উপলব্ধি, যেখানে মানুষ নিজের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে, আল্লাহর অনুগ্রহে মাথা নত করে। যে মুহূর্তে মহানবী (সা.) মক্কা জয় করলেন, তখন তাঁর চারপাশে ছিল হাজারো সৈন্য, তবু তাঁর চোখে ছিল অশ্রু, ঠোঁটে ছিল কৃতজ্ঞতার তাসবিহ। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিজয় সেদিন উদ্যাপিত হয়েছিল এক নীরব সিজদায়। আজও যে মুসলমান বিজয়ের পর সিজদায় পড়ে যায়, গরিবকে খাওয়ায়, ক্ষমা করে, অহংকার ত্যাগ করে; সেই মানুষই সত্যিকারের বিজয়ী।
লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামি লেখক ফোরাম; পরিচালক, সম্পাদনা কেন্দ্র