অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের চারপাশজুড়ে থাকা সমুদ্রতলে তাপবর্ধক মিথেন গ্যাসের নিঃসরণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এটি বিজ্ঞানীদের গভীর উদ্বেগে ফেলেছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, অঞ্চলটি উষ্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রের তলদেশে নতুন নতুন ফাটল তৈরি হচ্ছে। এসব ফাটল দিয়ে বিপুল পরিমাণ মিথেন বেরিয়ে আসছে। এই আবিষ্কার ভবিষ্যতের জলবায়ু পরিবর্তনের পূর্বাভাসগুলোকে আরও ভয়াবহ করে তুলবে বলে আশঙ্কা করছেন গবেষকেরা।
শুক্রবার (১০ অক্টোবর) এই বিষয়ে এক প্রতিবেদনে সিএনএন জানিয়েছে, বিশ্বজুড়ে সমুদ্রতলের নিচে হাজার বছরের পুরোনো মিথেনের বিশাল ভান্ডার রয়েছে। অদৃশ্য এই গ্যাস যখন ফাটল বা ছিদ্রের মাধ্যমে ওপরে উঠে আসে, তখন পানির নিচে ছোট ছোট বুদ্বুদের মতো দেখা যায়। কিন্তু এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের জ্ঞান এখনো সীমিত। ওপরে উঠে আসা কতটা গ্যাস বায়ুমণ্ডলে পৌঁছায়, আর কতটা সমুদ্রের নিচের মাইক্রোবসরা শোষণ করে নেয়, বিজ্ঞানীদের কাছে তা এখনো স্পষ্ট নয়।
তবে জানা গেছে, মিথেন গ্যাস কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে প্রায় ৮০ গুণ বেশি তাপ ধরে রাখতে সক্ষম। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য এই গ্যাসকে একটি ‘সুপার দূষণকারী’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
অ্যান্টার্কটিকার মিথেন নিঃসরণ এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে কম অধ্যয়ন করা ক্ষেত্রগুলোর একটি। এই কারণে আন্তর্জাতিক গবেষকদের একটি দল সম্প্রতি ‘রস সাগরে’ অভিযান চালায়, যা অ্যান্টার্কটিকার দক্ষিণ মহাসাগরের অংশ। তাঁরা জাহাজভিত্তিক শব্দতরঙ্গ বিশ্লেষণ, দূরনিয়ন্ত্রিত যান এবং ডাইভার ব্যবহার করে ১৬ থেকে ৭৯০ ফুট গভীরতায় গবেষণা চালান।
ফল ছিল চমকপ্রদ। তাঁরা ৪০টির বেশি নতুন মিথেন নিঃসরণের উৎস খুঁজে পান, যার বেশির ভাগ আগে বহুবার অধ্যয়ন করা হয়েছিল, অথচ আগে কোনো নিঃসরণ দেখা যায়নি। এ-সম্পর্কিত গবেষণাপত্রটি ‘নেচার কমিউনিকেশন’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এটিকে একটি ‘মৌলিক পরিবর্তন’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
নিউজিল্যান্ডের ‘আর্থ সায়েন্সেস ইনস্টিটিউট’-এর সামুদ্রিক বিজ্ঞানী ও গবেষণাটির সহলেখক সারাহ সিব্রুক বলেছেন, ‘যা একসময় বিরল বলে মনে করা হতো, এখন তা দ্রুত বিস্তার লাভ করছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিটি নতুন নিঃসরণ আবিষ্কারের মুহূর্তে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে ভয়ও জন্ম নিচ্ছে। কারণ, এগুলো সরাসরি বায়ুমণ্ডলে গ্যাস ছড়িয়ে দিতে পারে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির পূর্বাভাসে এগুলোর কথা এখনো বিবেচনাই করা হয়নি।’
গবেষকেরা আশঙ্কা করছেন, এই গ্যাস সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলবে। কেন এই নিঃসরণ হচ্ছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়; তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা, জলবায়ু পরিবর্তনই এর অন্যতম কারণ হতে পারে।
উত্তর মেরু অঞ্চলেও একই রকম মিথেন নিঃসরণের সঙ্গে অতিরিক্ত উষ্ণতা, সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তন ও বরফগলার সম্পর্ক পাওয়া গেছে। এতে একধরনের বিপজ্জনক প্রবণতা তৈরি হয়, যেখানে উষ্ণতা বাড়লে মিথেন বেড়ে যায়, আর মিথেন বাড়লে উষ্ণতা আরও বাড়ে।
গবেষক দলটি আরও গভীর বিশ্লেষণের জন্য আগামী সপ্তাহে আবারও দুই মাসের জন্য অ্যান্টার্কটিকায় যাত্রা করবে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী অ্যান্ড্রু থারবার বলেছেন, ‘অ্যান্টার্কটিকা এখন এক ভয়ংকর ভবিষ্যতের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। যদি উষ্ণায়ন চলতেই থাকে, এই অঞ্চল একদিন হয়ে উঠতে পারে বিপদের কেন্দ্রবিন্দু।’