ভারত বর্তমানে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি। অথচ দেশের অর্থনৈতিক শক্তির সঙ্গে পাসপোর্টের ক্ষমতার কোনো সামঞ্জস্য নেই। সম্প্রতি প্রকাশিত হেনলি পাসপোর্ট সূচকে ভারতের পাসপোর্টের দুর্বলতা আবারও প্রকট হয়েছে। ভিসামুক্ত ভ্রমণের সুবিধার ওপর ভিত্তি করে তৈরি এই সূচকে ভারত গত বছরের তুলনায় পাঁচ ধাপ পিছিয়ে ৮৫তম স্থানে নেমে এসেছে।
ভারতীয় নাগরিকদের জন্য পশ্চিমা ও ইউরোপীয় দেশগুলোতে ভিসা প্রাপ্তি এখনো একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মহল ভারতের ‘সফট পাওয়ার’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
বিশ্বের মোট ১৯৯টি পাসপোর্টের মধ্যে ভারতের বর্তমান অবস্থান ৮৫তম। এটি হতাশাজনক বলছেন পর্যবেক্ষকেরা। এর বিপরীতে রুয়ান্ডা (৭৮তম), ঘানা (৭৪তম) এবং আজারবাইজানের (৭২তম) মতো ভারতের তুলনায় অনেক ছোট অর্থনীতির দেশগুলো সূচকে এগিয়ে রয়েছে। বর্তমানে ভারতীয় পাসপোর্টধারীরা মাত্র ৫৭টি দেশে ভিসামুক্ত প্রবেশের সুবিধা পান, যা আফ্রিকার দেশ মৌরিতানিয়ার নাগরিকদের সমান।
অবশ্য গত দশকেও পাসপোর্ট সূচকে ভারত ৮০-এর ঘরেই ওঠানামা করেছে, এমনকি ২০২১ সালে ৯০-এর ঘরে নেমে গিয়েছিল। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং সিঙ্গাপুরের মতো এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় ভারতের জন্য এটি মোটেও সম্মানজনক নয়। এশিয়ার এই দেশগুলোর পাসপোর্ট বরাবরই সূচকের শীর্ষস্থানে থাকে।
গত বছরের মতো চলতি বছরও সিঙ্গাপুর ১৯৩টি দেশে ভিসামুক্ত ভ্রমণ সুবিধা নিয়ে সূচকের শীর্ষে অবস্থান করছে। দক্ষিণ কোরিয়ার অবস্থান দ্বিতীয়, ভিসামুক্ত ভ্রমণ সুবিধা আছে ১৯০টি দেশে। ১৮৯টি দেশে ভিসামুক্ত সুবিধা নিয়ে জাপানের অবস্থান তৃতীয়।
যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ১০০। বাংলাদেশি পাসপোর্টে ভিসামুক্ত গন্তব্যের সংখ্যা মাত্র ৩৮টি। উত্তর কোরিয়ার অবস্থানও একই।
পাসপোর্টের ক্ষমতা কেবল একটি ভ্রমণ নথি নয়; এটি একটি দেশের ‘সফট পাওয়ার’ এবং বৈশ্বিক প্রভাবকে প্রতিফলিত করে। একটি দুর্বল পাসপোর্ট নাগরিকদের জন্য আন্তর্জাতিক ব্যবসা, উচ্চশিক্ষা এবং পেশাগত সুযোগ সীমিত করে। এর ফলে ভিসা খরচ বাড়ে এবং ভ্রমণের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষার সময় তৈরি হয়।
বিগত এক দশকে ভারতে ভিসামুক্ত প্রবেশের সুযোগ দেওয়া দেশের সংখ্যা বাড়লেও, র্যাঙ্ক কেন পিছিয়েছে?
২০১৪ সালে ভারতে যখন প্রথম নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসে তখন ভিসামুক্ত ভ্রমণের সুযোগ ছিল ৫২টি দেশে এবং র্যাঙ্ক ছিল ৭৬তম। এর এক বছর পরই বড় ধাক্কা খায় ভারতীয় ভিসা, অবস্থান একলাফে ৮৫-তে নেমে যায়। এরপর ২০২৩ ও ২০২৪ সালে একটু উন্নতি হয়, ৮০তম স্থানে ওঠে। এরপর ২০২৫ সালে আবার নেমে ৮৫তম স্থানে চলে গেছে। এই সময় ভারতীয়দের ভিসামুক্ত ভ্রমণ গন্তব্য ২০১৫ সালের ৫২ থেকে বেড়ে ২০২৩ সালে ৬০ এবং ২০২৪ সালে ৬২টি হয়েছে। স্পষ্টত ২০২৫ সালে ভিসা গন্তব্য ৫৭টিতে ঠেকলেও তা ২০১৫ সালের (৫২) তুলনায় বেশি। এরপরও পাসপোর্ট সূচকে ৮৫-তে নেমে যাওয়ার কারণ কী?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো বিশ্বব্যাপী ভূরাজনৈতিক গতিপ্রকৃতিতে তীব্র প্রতিযোগিতা। বৈশ্বিক গড় ভিসামুক্ত গন্তব্যের সংখ্যা ২০০৬ সালের ৫৮ থেকে বেড়ে ২০২৫ সালে ১০৯ হয়েছে। এর অর্থ হলো, বিশ্বের অন্যান্য দেশ দ্রুতগতিতে তাদের নাগরিকদের জন্য নতুন ভ্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কূটনৈতিক দৌড়ে ভারত পিছিয়ে পড়েছে।
যেখানে গত এক দশকে চীন তাদের ভিসামুক্ত গন্তব্যের সংখ্যা ৫০ থেকে বাড়িয়ে ৮২ করেছে, যার ফলে তাদের র্যাঙ্ক ৯৪ থেকে ৬০-এ উন্নীত হয়েছে। এই উদাহরণ স্পষ্ট করে, কূটনৈতিক উদ্যোগের মাধ্যমে র্যাঙ্ক দ্রুত উন্নত করা সম্ভব।
র্যাঙ্ক পতনের নেপথ্যে রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও নিরাপত্তাও বড় কারণ। সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত আচল মালহোত্রা এই র্যাঙ্ক পতনের পেছনে একাধিক অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক কারণ তুলে ধরেছেন।
মালহোত্রার মতে, ১৯৭০-এর দশকে ভারতীয়রা অনেক পশ্চিমা দেশে ভিসা ছাড়াই ভ্রমণ করতে পারতেন। কিন্তু ১৯৮০-এর দশকে খালিস্তান আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা ভারতের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তিকে আঘাত করে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমা দেশগুলো ভিসা নীতি কঠোর করে। পরবর্তী রাজনৈতিক উত্থান-পতন ভারতের স্থিতিশীলতা নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তোলে।
মালহোত্রা উল্লেখ করেন, অনেক দেশই বর্তমানে অভিবাসন নিয়ে অত্যন্ত সতর্ক। ভারত থেকে অন্য দেশে স্থায়ীভাবে যাওয়া বা ভিসার মেয়াদ শেষেও থেকে যাওয়ার হার বেশি হওয়ায় তা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের সুনামের ওপর প্রভাব ফেলছে।
হেনলি বৈশ্বিক পাসপোর্ট সূচকে বিভিন্ন দেশের অবস্থান:
এ ছাড়া পাসপোর্টের নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং জটিল পদ্ধতিকেও এই পতনের জন্য দায়ী করেছেন মালহোত্রা। তিনি বলেন, পাসপোর্টের নিরাপত্তা এবং অভিবাসন পদ্ধতিও ভিসামুক্ত প্রবেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ২০২৪ সালে শুধু দিল্লি পুলিশই ভিসা এবং পাসপোর্ট জালিয়াতির অভিযোগে ২০৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। ভারতের ধীরগতির ভিসা প্রক্রিয়াকরণ এবং জটিল অভিবাসন পদ্ধতিও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারণ। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও বিশ্ব রাজনীতিতে ‘আইসোলেশন’ বা বিচ্ছিন্নতার প্রবণতার কারণে সূচকে ঐতিহাসিক সর্বনিম্ন ১২তম স্থানে নেমে এসেছে। যেখানে আগের বছরও শীর্ষ ১০-এ ছিল।
এদিকে পাসপোর্টের নিরাপত্তা বাড়ানো এবং অভিবাসন প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য ভারত সম্প্রতি ইলেকট্রনিক পাসপোর্ট বা ই-পাসপোর্ট চালু করেছে। এতে ছোট একটি চিপের মাধ্যমে বায়োমেট্রিক তথ্য সংরক্ষিত থাকে, যা জালিয়াতি রোধে অত্যন্ত কার্যকর হবে।
তবে বিশেষজ্ঞদের মত হলো, শুধু প্রযুক্তিগত উন্নতিই যথেষ্ট নয়। ভারতীয়দের বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা ও প্রভাব বাড়াতে হলে ব্যাপক কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে এবং দ্রুত নতুন নতুন ভ্রমণ চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে। অর্থনৈতিক শক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাসপোর্টের র্যাঙ্ক উন্নত করতে সরকারের এই বিষয়ে আরও মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, হেনলি পাসপোর্ট ইনডেক্স