হোম > বিশ্ব > ভারত

আসাম পুলিশ আটকের পর নিখোঁজ, ৬ মাস পর বৃদ্ধ সকিনা ঢাকার কারাগারে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­

১০ নভেম্বর শুনানির জন্য কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নিয়ে আসা হয় সকিনা বেগমকে। ছবি: পারভেজ আহমেদ রনি

পরিবার ভেবেছিল, ভারতের আসাম রাজ্যের ৬৮ বছর বয়সী বৃদ্ধ সকিনা বেগম নিখোঁজ। কিন্তু না, তিনি এখন ঢাকার কাশিমপুর কারাগারে। দ্য কন্ট্রোল অব এন্ট্রি অ্যাক্ট, ১৯৫২ আইনে তাঁকে ৫৩ দিন ধরে আটক রাখা হয়েছে। অভিযোগ, তাঁকে ভারত থেকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়।

আসামের নলবাড়ি জেলার বারকুরা গ্রামের বাসিন্দা সকিনা বেগমকে গত মে মাসে তাঁর বাড়ি থেকে হেফাজতে নেয় আসাম পুলিশ। এরপর তিনি দীর্ঘদিন নিখোঁজ ছিলেন এবং তাঁর পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়নি। জুনের প্রথম সপ্তাহে সকিনাকে ঢাকার মিরপুর ভাষানটেক এলাকায় রাস্তার পাশে একজন পথচারী খুঁজে পান।

ভাষানটেক এলাকার বাসিন্দা জাকিয়া বেগম নামের এক নারী সকিনাকে খুঁজে পেয়ে আশ্রয় দেন। জাকিয়া ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়্যারকে জানান, কোরবানির ঈদের চার দিন আগে তিনি তাঁর বাড়ির সামনের একটি দোকানের কাছে সকিনাকে রাস্তার পাশে বসে থাকতে দেখেন। বৃদ্ধাকে অসুস্থ ও বিপর্যস্ত অবস্থায় দেখে জাকিয়া তাঁকে বাড়িতে নিয়ে আসেন, চিকিৎসা ও সেবা দেন।

প্রায় ১৫ দিন পর জাকিয়া বুঝতে পারেন, সকিনা ভারতের আসামের বাসিন্দা। ভাষা, সকিনার বয়স ও স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে জাকিয়া ভাষানটেক বস্তির অন্যদের সঙ্গে নিয়ে প্রায় চার মাস তাঁকে আশ্রয় দেন। তাঁরা সকিনাকে আসামে ফেরত পাঠানোর উপায় খুঁজতে থাকেন।

তাঁরা বিবিসি বাংলার একজন প্রতিবেদকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সকিনার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সেই প্রতিবেদক আসামে অনুসন্ধান চালিয়ে তাঁর পরিবারকে খুঁজে বের করতে সক্ষম হন। বিবিসির রিপোর্টটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর ভাষানটেক থানা সকিনাকে হেফাজতে নেয়। পরে তাঁকে আদালতে হাজির করা হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে পাসপোর্ট বা ভিসা ছাড়া বাংলাদেশে থাকার অভিযোগ আনা হয়।

সকিনার মেয়ে রশিয়া বেগম জানান, তাঁর মা বছরের পর বছর ধরে ভারতে আইনি জটিলতায় জড়িয়ে ছিলেন। ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য এক দপ্তর থেকে আরেক দপ্তরে ছুটছিলেন। গত মে মাসে পুলিশ তাঁর মাকে স্বাক্ষর করানোর জন্য থানায় নিয়ে যায় এবং পরিবারকে আশ্বস্ত করে যে তাঁকে বাড়িতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কয়েক দিন কেটে গেলেও তিনি ফেরেননি। পরে পরিবার থানায় যোগাযোগ করলে তাদের জানানো হয়, সকিনা সেখানে নেই এবং তাঁকে মাটিয়া ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

রশিয়া জানান, তাঁরা চার মাস ধরে নিখোঁজ মায়ের সন্ধান করেছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন, ২০১২ সালের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের একটি রায়ে সকিনাকে বিদেশি নাগরিক ঘোষণা করা হয়েছিল। চরম দরিদ্র পরিবারের হওয়ায় তাঁরা পর্যাপ্ত আইনি পরামর্শ পাননি এবং মামলা লড়তে গিয়ে সব সম্পদ হারিয়েছেন।

২০১৬ সাল থেকে সকিনা কোকরাঝাড় ডিটেনশন সেন্টারে আটক ছিলেন। ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের আদেশে জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর তাঁকে নিয়মিতভাবে নলবাড়ি থানায় হাজিরা দিতে হতো। তিনি সর্বশেষ এই বছরের ২৫ মে থানায় হাজিরা দেন—এরপর থেকে তাঁর পরিবার তাঁকে খুঁজে পায়নি।

পরিবার কোথাও খুঁজে না পেয়ে আসামভিত্তিক একটি সংস্থার হেল্পলাইনে কল করে জানতে পারে, সকিনা বেগমকে ২৬ মে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে ধুবড়ির পানবাড়ি সেক্টর সদর দপ্তরে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ওই সময়ে আসাম সরকার নথিপত্রহীন অভিবাসী সন্দেহে স্থানীয় কিছু মানুষকে ভারত থেকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার জন্য ‘পুশ-ব্যাক নীতি’ প্রয়োগ করছিল।

ধারণা করা হয়, ওই সময় ১ হাজারের বেশি মানুষকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়। তবে ভারত সরকার এর কোনো আনুষ্ঠানিক তথ্য প্রকাশ করেনি। সকিনাও এই পরিণতির মুখোমুখি হয়েছেন।

বিবিসি বিএসএফের কাছে সকিনার বিষয়ে জানতে চাইলে তারা কোনো সাড়া দেয়নি।

বিবিসির প্রতিবেদক সকিনার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ভিডিও কলের মাধ্যমে রশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি স্বস্তি পান যে তাঁর মা বেঁচে আছেন। তবে এই স্বস্তি ক্ষণস্থায়ী ছিল; কারণ, তিনি জানতে পারেন, তাঁর মাকে অবৈধভাবে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। জাকিয়ার মতো একজন অচেনা মানুষ তাঁর মায়ের যত্ন নিচ্ছেন জেনে তিনি স্বস্তি পেলেও খবরটি প্রকাশের পর পুলিশ সকিনাকে নিয়ে গিয়ে জেলে দেবে, তা তিনি কল্পনাও করেননি।

সকিনাকে আশ্রয় দেওয়া জাকিয়া একজন গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন। তিনি ঢাকার মিরপুরের ভাষানটেকের বাসিন্দা। ছবি: পারভেজ আহমেদ রনি

বাংলাদেশে জাকিয়ার আইনি লড়াই

ভাষানটেকের ৪০ বছর বয়সী গৃহকর্মী জাকিয়া এখন বাংলাদেশে সকিনার মুক্তির জন্য আইনি লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি জানান, দিশেহারা বৃদ্ধাকে খুঁজে পাওয়ার পর প্রথমে যোগাযোগ করতে তাঁকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।

বিবিসির রিপোর্ট প্রকাশের পর বাংলাদেশ পুলিশ গত ২৫ সেপ্টেম্বর পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়া অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য ‘দ্য কন্ট্রোল অব এন্ট্রি অ্যাক্ট, ১৯৫২’-এর অধীনে সকিনার বিরুদ্ধে একটি মামলা করে। এফআইআরে বলা হয়েছে, পুলিশ ভাষানটেক বস্তি এলাকার একটি গলির প্রবেশপথ থেকে সকিনাকে ধরেছে। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি তাঁর বাড়ি ভারতের আসামে বলে জানান। যদিও তিনি কিছু বাংলা এবং তাঁর আঞ্চলিক অসমীয়া ভাষা বলতে পারেন, কিন্তু পাসপোর্ট বা ভিসা দেখাতে পারেননি। পুলিশের অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, সকিনা কীভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন বা ঢাকার ভাষানটেক এলাকায় পৌঁছেছেন, সে সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারেননি।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সাব-ইন্সপেক্টর শেখ মো. আলী সনি সকিনাকে আদালতে হাজির করেন এবং তাঁকে জেলে আটক রাখার জন্য আদালতের নির্দেশ চান। শুনানি শেষে বিচারক তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

ঢাকায় আদালতে জাকিয়ার পক্ষে সকিনার জামিনের আবেদন করা অ্যাডভোকেট রহমত উল্লাহ বলেন, ‘আমি তিনবার জামিনের আবেদন করেছি, কিন্তু প্রতিবারই আদালত তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তবে জেল কোড অনুযায়ী চিকিৎসার জন্য একটি আবেদন গৃহীত হয়েছে। সর্বশেষ শুনানি ছিল ১০ নভেম্বর, সেখানেও জামিনের আবেদন বাতিল করা হয়। আমরা তাঁর বয়স বিবেচনা করে নিরাপদ হেফাজতে রাখারও আবেদন করেছিলাম, কিন্তু সেটিও প্রত্যাখ্যান করা হয়।’

জাকিয়ার মতো একজন গৃহকর্মীর জন্য এই আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়া কঠিন ও ব্যয়বহুল। তবু তিনি তাঁর আশপাশের মানুষের আর্থিক সহায়তায় মামলাটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত চালিয়ে যেতে চান। সকিনাকে ভারতে ফেরত পাঠানোর আগপর্যন্ত জাকিয়া তাঁকে নিজের কাছে রাখতে চান।

অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

তবে সকিনার ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত। ভারতে তাঁর নাগরিকত্ব নিয়ে আইনি লড়াইয়ের মধ্যে তিনি এখন অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশের অভিযোগ অভিযুক্ত। আসামে তাঁর পরিবার তাঁর ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য আধার কার্ড এবং তাঁর বাবা আসামের ভোটার ছিলেন—এমন নথি পেশ করেছে। তাঁরা যুক্তি দেন, একজন বিদেশি নাগরিকের পক্ষে এমন সরকারি নথি থাকা অসম্ভব। আবার বাংলাদেশেও তাঁকে নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করবে না। এই পরিস্থিতিতে সকিনার বাড়ি ফেরা হবে কি না, তা নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা।

বাংলাদেশি সাংবাদিক পারভেজ আহমেদ রনি ১০ নভেম্বর ঢাকার আদালতে সকিনার সঙ্গে দেখা করেন। তিনি কেমন আছেন জানতে চাইলে সকিনা হতভম্বের মতো চারদিকে তাকান, কারণ, নারী পুলিশ কর্মকর্তারা তাঁকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি জাকিয়ার দিকে বারবার তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন। এর কিছুক্ষণ পরেই তাঁকে প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়। প্রতিবেদকের কাছে তাঁর একমাত্র প্রশ্ন ছিল তাঁর মেয়ের কুশল নিয়ে।

মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলে ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশন এই প্রতিবেদককে জানায়, ‘আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে এই বিষয়ে অবগত নই। একবার আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের জানানো হলে আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’

দ্য ওয়্যার থেকে অনূদিত

গাজা স্থিতিশীলতা বাহিনীতে যোগ দিতে প্রস্তুত পাকিস্তান, তবে আপত্তি হামাসকে নিরস্ত্র করার শর্তে

ট্রাম্প-জেলেনস্কি বৈঠকের আগে ইউক্রেনে রাশিয়ার ব্যাপক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা

গুয়াতেমালায় বাস খাদে পড়ে নিহত অন্তত ১৫, আহত ১৯

সোমালিল্যান্ডকে ইসরায়েলের স্বীকৃতি—‘রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন’ আখ্যা দিয়ে প্রতাহারের দাবি সোমালিয়ার

বেঙ্গালুরুতে ‘বুলডোজার রাজ’: ৪০০ মুসলিম পরিবারকে উচ্ছেদ, তোপের মুখে কর্ণাটকের কংগ্রেস সরকার

নাইজেরিয়ায় হামলা: ‘বড়দিনের উপহার’ বলে উদ্‌যাপন ট্রাম্প প্রশাসনের, স্থানীয়রা বলছেন—‘কখনো আইএস দেখিনি’

রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর দ্বিতীয়বার যুদ্ধবিরতিতে থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া

চীনা প্রযুক্তির প্রথম যাত্রীবাহী উড়োজাহাজের ককপিটে প্রথম নারী ক্যাপ্টেন

২ সেকেন্ডে ঘণ্টায় ৭০০ কিমি গতি, চোখের পলকে ছুটে বিশ্ব রেকর্ড গড়ল চীনের ট্রেন

সন্ত্রাসী হামলার হুমকি, যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় শিক্ষার্থী মনোজ সাই গ্রেপ্তার