হোম > ছাপা সংস্করণ

ভিসি উদ্ধারে শিক্ষার্থীর রক্ত ঝরানো অমানবিক

ড. মো. ফখরুল ইসলাম

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মামুলি ঘটনার জেরে তুলকালাম কাণ্ড জাতির বিবেককে নাড়িয়ে তুলেছে। অভিযোগ এসেছিল ছাত্রীদের পক্ষ থেকে। তাঁরা তাঁদের হলের প্রভোস্টের বিরুদ্ধে নানা কারণে পদত্যাগ দাবি করেছিলেন ভিসি মহোদয়ের কাছে। এ রকম অভিযোগ ও সমস্যা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে হরদম হয়ে থাকে। এর চেয়েও বড় সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধান করার বহু নজির রয়েছে। ভালোভাবে যুক্তি দিয়ে শিক্ষার্থীদের বোঝানো হলে তাঁরা সব সময় শিক্ষকদের কথা মান্য করেন। কারণ, শিক্ষার্থীরা তাঁদের বাবা-মায়ের পর শিক্ষকদের পিতৃ-মাতৃতুল্য শ্রদ্ধার আসনে বসিয়ে থাকেন।

শিক্ষার্থীরাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাণ। তাঁরা অনেক সময় ভুল করলেও নিজের ভুল বুঝতে পেরে নিজেরাই অনেক সমস্যার সমাধান করতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু শাবিপ্রবির ঘটনা সামান্য আন্দোলন থেকে কেন এত বড় সমস্যা হয়ে মামলা-মোকদ্দমার দিকে গড়িয়ে ভিসির পদত্যাগের এক দফা দাবি হিসেবে গড়িয়ে গেল, তা এক কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি করে তুলেছে জাতিকে।

দেশের স্বনামধন্য ও সুনামধারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নিজস্ব গৌরব রয়েছে। যেখানে আমিও বহুদিন শিক্ষকতা করেছিলাম। তখনকার ছাত্র-শিক্ষক মধুর সম্পর্কের স্মৃতি আজও মনে পড়ে। কিন্তু আজকের এই ন্যক্কারজনক ঘটনা সেই মধুর স্মৃতিকে যেন বারবার দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছে। শিক্ষার্থীরা মনে হচ্ছে তাঁদের কর্তৃপক্ষের ওপর চরমভাবে নাখোশ। তাঁরা ভিসি মহোদয়ের বাসভবনের সামনে জটলা করছে, স্লোগান দিচ্ছে, হাততালি দিয়ে নিজেদের দাবিগুলো জোর গলায় পেশ করছে। শিক্ষার্থীরা এ ধরনের দাবিদাওয়া মাঝেমধ্যে বড়-ছোট সব বিশ্ববিদ্যালয়েই করে থাকেন। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর একটা গ্রহণযোগ্য সমাধান পেয়ে যায় ও তাঁদের কণ্ঠস্বরও ঠান্ডা হয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। এটাই অলিখিত নিয়ম।

ঘটনার প্রথম দিন আমরা টিভি ও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ভাষা ও গতি দেখে ভেবেছিলাম যে পরদিন সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে।

কিন্তু না। পরের দিনের ঘটনাবলি দেখে মনে হলো শাবিপ্রবির পবিত্র অঙ্গন যেন একটি মিনি যুদ্ধক্ষেত্র। প্রথমে একদল মানুষ কর্তৃক ঠেলাঠেলি, ধাক্কাধাক্কির পর লাঠির খটাখট বাড়ি পড়ার পর বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ। এরপর শক্ত পেশাদারি লাঠির দমাদম পিটুনি, বন্দুকের রাবার গুলি, সাউন্ড গ্রেনেডের মুহুর্মুহু বিকট শব্দ, দৌড়াদৌড়ি, কান্নাকাটি ইত্যাদির দৃশ্য টিভিতে দেখে মনে হলো পরিস্থিতি আসলে ভয়ানক মোড় নিয়েছে। ফিলিস্তিনে যেমন বাচ্চাদের ইটপাটকেলের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি সেনারা কামানের গোলা ছুড়ে চারদিকে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে ক্যামেরার গ্লাস ঘোলা করে দেয়, ঠিক তেমনি একটি দৃশ্যপট। মোটেও বেশি বললাম না। যাঁরা খবর দেখেছেন তাঁরা আমার কথা কিছুতেই অবিশ্বাস করতে পারবেন না।

দৈনিক পত্রিকায় দেখলাম শিক্ষার্থীদের ভবনের দরজা থেকে তাড়ানোর জন্য লাঠিপেটা করার পাশাপাশি ২১টি গুলি ও ২৩টি সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়েছে সেদিন। উদ্দেশ্য ভিসি মহোদয়কে ‘উদ্ধার’ করতে হবে। এই শব্দটিই ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদে। কই, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে তখনকার ভিসি মহোদয় শিক্ষার্থীদের দ্বারা সারা দিন তালাবদ্ধ থেকে পুলিশ ডেকে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি-গ্রেনেড ছুড়তে বলেননি। একজন ভিসিকে অনেক সময় ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। তিনি কেন অধৈর্য হবেন? শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের কাছে আদরের নিজ সন্তানতুল্য। এ কথা যদি মনে ধারণ না করতে পারেন, তাহলে তিনি ওই পদে দায়িত্ব নিতে যাবেন কেন? আজকাল অনেক ভিসি যথার্থ জ্ঞান ও যুক্তি দিয়ে মেধাবী বা বুদ্ধিমান ছাত্রদের সঙ্গে কথাও বলতে অপারগ। সেটাই আজকাল অনেক ভিসির চরম দুর্বলতা।

আজকাল সবাই সব জায়গায় প্রশাসক হতে চান। একজন ভালো গবেষক হতে সবার দ্বিধা। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা শুধু শিক্ষক নন। তাঁরা একাধারে শিক্ষক ও বিশিষ্ট গবেষক। এটাই এই চাকরির বিশেষত্ব বা সবিশেষ নিয়ম। কিন্তু আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক গবেষক হতে চান না। তাঁরা নিজেদের প্রশাসক ভাবতে ভালোবাসেন। অথচ সে কাজে অনেকে অযোগ্য বা অনেকেরই কোনো প্রশিক্ষণ ও নৈতিক গুণাবলি থাকে না। আজকাল বেশির ভাগ শিক্ষক কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকেন। অনেকের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে থাকে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। আবার অনেক শিক্ষক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকেন। একটি ক্লাস নিয়েই ব্যবসার তাগিদে দেন দৌড়। এদের অনেকেই নিয়ম অমান্য করে একটি প্রশাসনিক পদের জন্য সরকারি নানা দপ্তরে দৌড়াদৌড়ি করে নিজের মর্যাদাকে হেয়প্রতিপন্ন করে ভিসি নামক সোনার হরিণ লাভে তৎপর হন। কেউ কেউ এক মেয়াদ শেষ হলে আরও এক-দুই মেয়াদ বেশি থাকার জন্য তদবির শুরু করেন। দেখা গেছে, যাঁরা দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ভিসি পদ লাভ করেছেন, তাঁরা বেশি দুর্নীতি করতে তৎপর ছিলেন। তাঁরা অনেকে বেপরোয়া ভাব দেখিয়ে চলাফেরা ও বিভিন্ন একপেশে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিভিন্ন অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি করেছেন। এ জন্য অনেকের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। অনেককে মেয়াদ পূর্তির আগেই পদত্যাগ করতে হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘শাবিপ্রবিতে যা ঘটেছে তার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের নেই। পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে উপাচার্য যে ব্যর্থ হয়েছেন, তা-ই নয়, বরং শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার নির্দেশ দিয়ে ফৌজদারি অপরাধ করেছেন তিনি।’ (প্রথম আলো ১৯.০১. ২০২২)

শাবিপ্রবির দুঃখজনক ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, খুলনা ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ মিছিল ও পথসভা হয়েছে। ঢাবি ও রাবিতে হয়েছে মশাল মিছিল। কুবিতে মানববন্ধন হয়েছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে বাসাবাড়িতে থাকা ও মেসের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে এসে জমায়েত হয়ে আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। অনেকেই ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছেন ও কুশপুত্তলিকায় আগুন দিয়েছেন। তাঁরা এখন উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি তুলেছেন। এবং এই দাবিতেই শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বুধবার থেকে আমরণ অনশন শুরু করেছেন। অন্যদিকে শাবিপ্রবির ঘটনায় ‘২০০-৩০০ জন অজ্ঞাতনামা লোককে আসামি করে’ জালালাবাদ থানায় মামলা করা হয়েছে এবং রাষ্ট্রপতির উদ্দেশে শিক্ষার্থীদের খোলা চিঠি পাঠানো হয়েছে। উপাচার্যের অপসারণের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আমরণ অনশনের ঘোষণা দিয়েছেন (দৈনিক ইত্তেফাক ১৮.০১. ২০২২)। এ ছাড়া বিষয়টির সুরাহা নিয়ে বিভিন্ন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের হস্তক্ষেপ চলছে।

তবে যা-ই হোক না কেন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন প্রভোস্টের পদত্যাগের দাবিতে ছাত্রীদের আন্দোলন ভিসিপতনের আন্দোলনের মতো এত দূর গড়াবে, তা কারও কাম্য ছিল না। এখন সামনে আরও কী জটিলতা তৈরি হতে যাচ্ছে, তা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। করোনার যমজ ভ্যারিয়েন্ট ডেলমিক্রনের ঊর্ধ্বগতির এই কালো সময়ে সামনে কী ঘটবে, তার জন্য কেউ গভীর চিন্তা করছেন না। করোনাভীতি ছাড়াও একটি মামুলি ঘটনার জেরে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন নষ্ট হোক, এটা কারও কাম্য হতে পারে না।

শিক্ষক হতে হবে শিক্ষাবান্ধব, গবেষণাবান্ধব ও শিক্ষার্থীবান্ধব। শিক্ষক-শিক্ষার্থী কেউই হঠাৎ বিগড়ে গেলে চলবে না। পারস্পরিক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধের যথার্থ প্রকাশের মাধ্যমে শাবিপ্রবির মতো একটি পবিত্র শিক্ষাঙ্গন হয়ে উঠুক জ্ঞানার্জনের পবিত্র বাগান—এই প্রত্যাশা শাবিপ্রবির একজন সাবেক শিক্ষক হিসেবে আমার। আর শিক্ষার্থীদের একটি সুন্দর ভবিষ্যতের স্বার্থে একই চাওয়া সবার হওয়া উচিত।

লেখক: ড. মো. ফখরুল ইসলাম, ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ