দেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ ‘লোডশেডিং’। বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিংয়ের সময়সূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এমন সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে যা বলা হয়েছে, তা সরল করলে দাঁড়ায় ‘অর্থনৈতিক সংকট’ মোকাবিলায় আগে থেকেই নেওয়া সতর্কতা। প্রশ্ন হলো, লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে যতটা সাশ্রয় হবে, তার চেয়ে বেশি লোকসান গুনতে হবে না তো?
এই প্রশ্নের উত্তর এককথায় দেওয়াটা সহজ নয়। তবে চেষ্টা করা যেতে পারে। তার আগে লোডশেডিংয়ের কারণ হিসেবে সরকারি বয়ানটি আরেকবার জানা যাক।
সরকার বলছে, জ্বালানি তেলের লোকসান কমাতে ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে এই সিদ্ধান্ত কার্যকরও করা হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী এক-দেড় ঘণ্টা করে প্রতিদিন লোডশেডিংয়ের কথা বলেছেন। পাশাপাশি কোথাও কোথাও এই লোডশেডিং দুই ঘণ্টা পর্যন্ত হতে পারে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
এই ঘোষণা এসেছে ১৮ জুলাই। সবাই জানে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বেই জ্বালানি তেলের একটা সংকট তৈরি হয়েছে। দাম বেড়েছে। এতে লোকসান গুনতে হচ্ছে বলে দাবি সরকারের। এ জন্য ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের পাশাপাশি সপ্তাহে এক দিন পেট্রলপাম্প বন্ধ রাখার কথা বলা হলেও এর পূর্ণ দিকনির্দেশনা এখনো পাওয়া যায়নি। তবে এলাকাভিত্তিক সম্ভাব্য লোডশেডিংয়ের তালিকা এরই মধ্যে নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি)। এ নিয়েও নানা সমালোচনা চলছে। কারণ, বাস্তবের লোডশেডিংয়ের সঙ্গে প্রকাশিত তালিকা এবং জ্বালানি উপদেষ্টার ঘোষণার মিল পাওয়া যাচ্ছে না অনেক এলাকাতেই।
রাজধানীতেই বিভিন্ন এলাকায় দিনে ৩ ঘণ্টা, কোনো কোনো এলাকায় তারও বেশি লোডশেডিং হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। রাজধানীর বাইরের শহরগুলোতে এর দৈর্ঘ্য আরও বেশি। আর উপজেলা পর্যায়ে এমনকি ১০-১২ ঘণ্টার লোডশেডিং’য়ের খবরও পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে বিদ্যুতের সংকট বেশ বড় মাত্রায় তৈরি হয়েছে বলেই মনে হয়। বিশেষত যখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে যে নতুন নির্দেশনা দেওয়া হলো, সেখানে সরকারি দপ্তরগুলোতে ২৫ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের কথা বলা হয়।
সার্বিক পরিস্থিতিতে দুটি প্রশ্ন সামনে আসছে। প্রথমটি হলো, যদি না-ই মানা হয়, তবে ঘটা করে সময়সূচি প্রকাশ করা কেন? আর দ্বিতীয় প্রশ্নটি শুরুতেই উত্থাপন করা হয়েছে যে এই আর্থিক সাশ্রয়ের চেষ্টার কারণে লাভের চেয়ে লোকসান বেশি হবে না তো?
রাজধানীর জন্য ঘোষিত সময়সূচির দিকে তাকালে আবার আরেক চিত্র দেখা যায়। বলা হলো, সব এলাকায় সমানভাবে এক-দেড় ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ থাকবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ গেলে আর আসার নাম নেয় না, কিংবা এক-দেড় ঘণ্টা করে কয়েকবার বিদ্যুৎ যায়। কিন্তু কেন? এর উত্তর আছে ডিপিডিসি ও ডেসকোর কাছে। তারা বলছে, এক ঘণ্টা লোডশেডিং করার পরও প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ পাচ্ছে না রাজধানীতে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা এ দুই সরকারি প্রতিষ্ঠান। ফলে রুটিনের বাইরে গিয়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে তাদের।
বাস্তবতা হলো, রুটিনে হেরফেরের দায়টা মূলত নিম্ন আয়ের লোকেরাই মেটাচ্ছে। রাজধানীর অভিজাত এলাকাগুলো থেকে অন্তত ঘোষিত সময়সূচির চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় লোডশেডিং হওয়ার অভিযোগ এখন পর্যন্ত আসেনি। আর নিম্ন আয়ের মানুষ-অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় অতিমাত্রায় লোডশেডিংয়ের বাস্তবতা তো একেবারে সামনেই আছে।
না, এমনটা শুধু বাংলাদেশেই হয় বা হচ্ছে, তা বলা যাবে না। বিশ্বের যেসব দেশে লোডশেডিংয়ের বাস্তবতা আছে, সবখানেই দেখা যায় এ ধরনের বৈষম্য। দেখা যায়, বিদ্যুৎ-সংকট দেখা দিলেই নিম্ন আয়ের মানুষেরা ভোগান্তিতে পড়ছেন। এর কারণ, লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্ত আসে রাষ্ট্রের কাছ থেকে, আর রাষ্ট্র বস্তুটি এখনো অভিজাতদের কবজায়। অবশ্য প্রতিটি রাষ্ট্রই এ ধরনের সময়সূচি ঘোষণার ক্ষেত্রে একধরনের ‘সাম্য’ নীতি মেনে চলে। যদিও এই ‘সাম্য’ নামের সোনার পাথরবাটিটি থাকে শুধু কাগজে-কলমেই। বাস্তবে সব দেশেই লোডশেডিংয়ের সবচেয়ে বড় ধকল যায় নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর দিয়ে। বাংলাদেশেও তা-ই হচ্ছে।
আফ্রিকার দেশ জাম্বিয়ায় বিদ্যুৎ-সংকটের প্রেক্ষাপটে চলা লোডশেডিং এবং অর্থনীতিতে এর প্রভাব নিয়ে গত বছরের জানুয়ারিতে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ডেভেলপমেন্ট সাউদার্ন আফ্রিকা জার্নালে। সেখানে বলা হয়, সময়সূচি ঘোষণার সময় সাধারণত সব এলাকায় সমানভাবে লোডশেডিং করার কথা বলা হলেও বাস্তবে ভুগতে হয় নিম্ন আয়ের মানুষদের। অথচ অর্থনৈতিক বিবেচনায় এমন সিদ্ধান্ত ভুল। কারণ, বিদ্যুতের বিকল্প জোগাড়ের সামর্থ্য অভিজাতদের থাকলেও দরিদ্রদের তা থাকে না। আবার দরিদ্র-অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় দেখা যায়, বহু লোক নিজের ঘরের মধ্যেই ছোট ছোট উৎপাদনব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। বিদ্যুৎ না থাকলে তাঁর হাতে একদিকে বিকল্প থাকছে না, আবার এ জন্য তাঁর উৎপাদনও বন্ধ হচ্ছে। ফলে তিনি সরাসরি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এ কারণে অভিজাত এলাকায় লোডশেডিংয়ের কারণে হওয়া ক্ষতির চেয়ে দরিদ্র এলাকায় লোডশেডিংয়ের ক্ষতি অনেক বেশি।
একটু উদাহরণ দেওয়া যাক। রাজধানীর পাশে কামরাঙ্গীরচর বা এমন এলাকাগুলোয় বহু ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকারখানা রয়েছে। কেউ হয়তো আবাসিক ভবনের মধ্যে নিজের একটি রুমে ছোট যন্ত্র বসিয়ে বোতল বানাচ্ছেন, কেউ হয়তো কয়েকজন কর্মী নিয়ে তৈরি পোশাকের কারখানা চালু করেছেন আবার কেউ হয়তো চানাচুর বানাচ্ছেন। বিষয়টি নীতিনির্ধারকেরাও বেশ ভালো জানেন। কিন্তু এসব এলাকা আবার শিল্প এলাকা হিসেবেও স্বীকৃত নয়। জাতীয় অর্থনীতিতে এবং কর্মসংস্থানে এই ছোট ছোট কারখানার অবদান কিন্তু কম নয়। শিল্প এলাকা হিসেবে স্বীকৃত না হওয়ায় এগুলো বিশেষ নজরও পায় না। ফলে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের সাধারণ হিসাবেই এগুলো পড়ে যায়, যার সরাসরি প্রভাব পড়ে এখানকার বাসিন্দাদের রুটি-রুজি ও আরও বড় পরিসরে জাতীয় অর্থনীতিতে। ফলে লোডশেডিং অনেকটা অঘোষিতভাবেই আয় ও সামাজিক বৈষম্য বাড়ায়।
এবার আসা যাক মূল প্রশ্নে। এর অর্থনৈতিক মূল্য কত? বাংলাদেশে লোডশেডিংয়ের এ সূত্রটি কিন্তু উৎপাদন ও সরবরাহ সক্ষমতাজনিত নয়। এটি করা হচ্ছে জ্বালানি খাতে ব্যয় সাশ্রয় করতে। কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজারে অস্থিরতাকে। কিন্তু এই সংকটে কি আমরা নিজে থেকেই পড়লাম?
একটু খোলাসা করা যাক। গত জুনে বাজেট প্রস্তাব উত্থাপনের সময় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, ‘দেশে সম্প্রতি মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা (ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ) ২৫ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট। কিন্তু এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। বাড়তি এই সক্ষমতা অব্যবহৃতই থাকছে। কিন্তু এর পেছনে ব্যয়ও হচ্ছে। এ সময় না কিনলেও বিদ্যুৎ খাতের উদ্যোক্তাদের মোটা অঙ্কের অর্থ পরিশোধ করে আসছে সরকারি সংস্থা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এভাবেই ক্যাপাসিটি চার্জের নামে গত তিন বছর বিদ্যুৎ খাতে প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের পকেটে গেছে প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা। সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠানো পিডিবির প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। (দৈনিক সমকাল, ২০ জুলাই)
এর সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যাক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দেওয়া সর্বশেষ নির্দেশনাকে। সেখানে বলা হয়েছে এবারের বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে মোট বরাদ্দের ২০ শতাংশ সাশ্রয়ের কথা। বলা প্রয়োজন, এবারের বাজেটে এমনিতেই এই খাত আগের বাজেটের চেয়ে সংকুচিত হয়েছে। এবারের বাজেটে বিদ্যুৎ বিভাগ এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের জন্য বরাদ্দ ১ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা কমিয়ে ২৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা করা হয়। এর ২০ শতাংশ সাশ্রয় মানে ৫ হাজার ২১৩ কোটি টাকা। কিন্তু, তিন বছরে মোট ৫৪ হাজার হিসাবে গড়ে বছরে যে ১৮ হাজার কোটি টাকা করে গচ্চা গেল, তার কী হবে?
এই প্রশ্নের উত্তর জনতা অন্তত দিতে পারবে না; বরং ব্যয় সাশ্রয় চেষ্টা ও তার প্রভাবের দিকে তাকানো যাক। ২০১৩ সালে পাকিস্তান ডেভেলপমেন্ট রিভিউতে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশটিতে শুধু লোডশেডিংয়ের কারণে ১৭০ কোটি মার্কিন ডলারের (১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি) ক্ষতি হচ্ছে। পাকিস্তানে সে সময় বিদ্যুৎ-সংকট প্রকট হয়েছিল। বলা হতে পারে, এটা শুধু পাকিস্তানের সংকট হতে পারে। কিন্তু আসলেই কি তাই?
না, একই চিত্র দেখা গেছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। দেশটি এখনো বিদ্যুৎ-সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি মানিওয়েবে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দেশটির জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইসা সালাঙ্গা বলেছেন, লোডশেডিংয়ের কারণে দক্ষিণ আফ্রিকা বিনিয়োগ হারাচ্ছে ব্যাপকভাবে। সঙ্গে বিদ্যমান ব্যবসার ক্ষতির বিষয়টি তো আছেই। কতটা? তিনি বলছেন, দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষেত্রে প্রতিদিন এক-দেড় ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের জন্য দিনে লোকসানের পরিমাণ ১০ কোটি র্যান্ড (বর্তমান বিনিময়মূল্য অনুযায়ী ৫০ কোটি ৫০ লাখ টাকা)। আর দিনে ৬ ঘণ্টা করে লোডশেডিং হলে এই অঙ্ক ১২০ কোটি র্যান্ড বা ৬৬০ কোটি টাকা। বছরের হিসাবটি আর না করাই ভালো। একই ধরনের হিসাব পাওয়া যায় আরেক প্রতিবেশী দেশ নেপালের ক্ষেত্রেও।
অর্থাৎ, সরকারি নির্দেশনা পুরোপুরি রক্ষায় সমর্থ হলেও যে ৬-৭ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে, তার জন্য আর্থিক মাশুলই গুনতে হবে কমপক্ষে দুই-তিন গুণের বেশি। আর সামাজিক ও আয়বৈষম্য বৃদ্ধির কারণে হওয়া অন্য সংকট তো বাদই থাকল। সঙ্গে রয়েছে শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে পড়া এর সরাসরি প্রভাব।
বাংলাদেশে লোডশেডিংয়ের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার বরাবরের মতোই নিম্ন আয়ের মানুষেরা হবে, এটা আর না বললেও চলে। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে বলা প্রয়োজন বিপুলসংখ্যক তরুণ জনগোষ্ঠীর কথা, যাঁদের একটি বড় অংশ স্বউদ্যোগে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন। তরুণদের একটি বড় অংশ ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজে যুক্ত। এফ-কমার্সের পরিসর বাড়ছে। ইন্টারনেটভিত্তিক কার্যক্রম ও আয়ের উৎস সম্প্রসারিত হচ্ছে। লোডশেডিং তাঁদের কর্মসংস্থান ও আয়ে বড় ভাগ বসাবে। এ অবস্থায় বিদ্যুতের ঘাটতি অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে নিঃসন্দেহে, যার মূল্য ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে বেঁচে যাওয়া টাকার চেয়ে অনেক বেশি।
লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা