দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ায় ছিলেন নরসিংদীর ব্যবসায়ী রমিজ উদ্দীন (৬৫)। দেশে ফিরেছেন প্রায় ১৫ বছর। গরু কেনাবেচার ব্যবসা করছিলেন। কিছুদিন আগে একটি বড় খামারের স্বপ্ন দেখা শুরু করেন তিনি। প্রতিনিয়ত মসজিদে নামাজ পড়ার সূত্রে সেই স্বপ্নের সহযোগী হয়ে ওঠেন স্থানীয় মসজিদের মুয়াজ্জিন মো. জাকির হোসেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সামান্য অর্থের লোভে সেই স্বপ্নসারথি মুয়াজ্জিন হয়ে ওঠেন রমিজ উদ্দীনের হন্তারক।
কম দামে গরু কেনার প্রলোভন দেখিয়ে এক রাতে রমিজ উদ্দীনকে সঙ্গে নিয়ে যান জাকির হোসেন। গরুবোঝাই ট্রাক আসবে বলে এক কলাবাগানের ভেতরে নিয়ে রাতের অন্ধকারে হাতুড়ি দিয়ে মুখে, কপালে, চোখে এবং মাথার বিভিন্ন স্থানে আঘাত করেন। মৃত্যু নিশ্চিত হলে রমিজ উদ্দীনের সঙ্গে থাকা ৬ লাখ টাকা নিয়ে ফিরে আসেন মসজিদে। মসজিদে ফিরে ফজরের আজান দেন জাকির। এরপর স্বাভাবিকভাবেই বাচ্চাদের আরবি পড়াতে থাকেন তিনি।
বুধবার সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ব্যবসায়ী রমিজ উদ্দীন হত্যা প্রসঙ্গে এসব জানিয়েছেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন।
খন্দকার আল মঈন জানান, ব্যবসায়ী রমিজ উদ্দীন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত মুয়াজ্জিন মো. জাকির হোসেনকে (৩৬) মঙ্গলবার (২১ ডিসেম্বর) লক্ষ্মীপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তিনি আত্মগোপনে থাকতে ৪০ দিনের চিল্লায় ছিলেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার জাকির হোসেন হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
র্যাবের গণমাধ্যম শাখার এই পরিচালক আরও জানান, ৩ অক্টোবর সকাল ৬টায় কিশোরগঞ্জের কাটবাড়িয়া ডাউকিয়া মসজিদের দক্ষিণ পাশে গুরুতর আহত অবস্থায় একজনকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তিনি বলেন, ‘মৃত ব্যক্তির পাঞ্জাবির পকেটে থাকা কাগজপত্রের মাধ্যমে তাঁর পরিচয় শনাক্ত করা হয়। মৃত ব্যক্তির নাম রমিজ উদ্দীন। এ ঘটনায় নিহতের ছেলে বাদী হয়ে কিশোরগঞ্জ মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।’
খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘পাঁচ বছর ধরে নরসিংদীর মনোহরদীর একটি গ্রামের মসজিদে মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজ করেন জাকির। এই এলাকায় রমিজ উদ্দীন একজন উঠতি ব্যবসায়ী ছিলেন। মূলত অর্থ আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যেই জাকির রমিজ উদ্দীনকে হত্যা করে।’
জিজ্ঞাসাবাদে জাকির আরও জানান, গরু কিনতে ৩০ সেপ্টেম্বর ব্যাংক থেকে ৬ লাখ টাকা তোলেন রমিজ। এরপর ২ তারিখ রাতে প্রথমে মনোহরদী থেকে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী এবং পরে বড়পুল এলাকায় যান। সেখান থেকে রিকশায় কাটাবাড়িয়া ডাউকিয়া মসজিদ এলাকায় যান। এ সময় জাকির গাড়িতে করে গরু এখানে আসবে বলে রমিজকে জানান এবং দুজন অপেক্ষা করতে থাকেন।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘রাত আনুমানিক দেড়টার সময় জাকির রমিজ উদ্দিনকে বলেন তিনি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাবেন। এ সময় রমিজও একই ইচ্ছা পোষণ করেন। তখন ডাউকিয়া মসজিদের দক্ষিণ পাশের কলাবাগানে যান তাঁরা। একপর্যায়ে জাকির তাঁর ব্যাগ থেকে হাতুড়ি বের করে পেছন থেকে বসে থাকা রমিজ উদ্দীনের মাথায় সজোরে আঘাত করেন। হাতুড়ির আঘাতে রমিজ উদ্দীন মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তাঁর কপালে, মুখে, বাম চোখের ওপর ও নিচে এবং মাথার বিভিন্ন স্থানে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করতে থাকেন।’
খন্দকার আল মঈন জানান, হত্যার পর জাকির রাতেই মনোহরদীতে ফিরে আসেন। ফজরের আজানের সময় হয়ে যাওয়ায় মসজিদে গিয়ে আজান দেন এবং নামাজে অংশগ্রহণ করেন। মক্তবে আসা ২০ জন ছাত্রকে আরবি পড়ান। তিনি বলেন, ‘কিন্তু পরদিন সকালে রমিজ উদ্দীনের মৃত্যুর বিষয়টি জানাজানি হলে জাকির ভয় পেয়ে মসজিদ থেকে ছুটি নিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। এ সময় তিনি নরসিংদী, ময়মনসিংহ ও সিলেটের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে থাকে। পরে ঢাকার একটি মসজিদে এসে সেখান থেকে ৪০ দিনের চিল্লায় লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে চলে যান।’
জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাবের এই কর্মকর্তা আরও জানান, জাকির ঘটনার প্রায় দুই মাস আগে রমিজ উদ্দীনকে হত্যা করে টাকা লুটের পরিকল্পনা করেন। এ ছাড়া হত্যার উদ্দেশ্যে বহনকৃত হাতুড়িটি হত্যার আগের রাতে কিনেছিলেন। জাকির লুট করা ১ লাখ টাকা খরচ করেছেন এবং বাকি টাকা ছয় ব্যক্তির কাছে গচ্ছিত রেখেছে। খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘সেই সব গচ্ছিত টাকা উদ্ধার এবং হত্যাকারীকে কিশোরগঞ্জ থানায় পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।’