গত ১৫ মাসে অর্থনীতি স্থির হতে পারেনি। চাপ বাড়লে কখনো পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেছে, আবার কিছুটা সামলে ওঠার ইঙ্গিতও এসেছে। কিন্তু ঠিক যখনই পথ পরিষ্কার মনে হয়েছে, তখনই নতুন সমস্যা আঘাত করেছে। ফলে পুরোনো সংকট আবার মাথা তোলে, আর অগ্রগতি থেমে যায়। এগোতে যতটা পারে, তার চেয়ে বেশি পিছিয়ে পড়তে হয়। এই ওঠানামা আর ঘন ঘন ধাক্কাতেই উন্নতির গতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, আর ক্ষতির চক্রও বারবার ফিরে আসছে।
চলতি অর্থবছরে দেশের অর্থনীতি সম্প্রসারণের গতিপ্রবাহ নিয়ে আজ রোববার প্রকাশ করা ‘বাংলাদেশ পারচেজিং ম্যানেজার্স’ ইনডেক্স (পিএমআই)–নভেম্বরের প্রতিবেদনে এমন চিত্রই ফুটে উঠেছে।
পিএমআই প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অক্টোবর মাসে দেশের অর্থনীতি যে হারে সম্প্রসারণ হয়েছিল, নভেম্বরে তার গতিবিধি অগ্রসরমুখী না হয়ে বরং বাঁকবদলে অনেকটাই নিম্নমুখী হয়েছে। এ সময় কৃষি, নির্মাণ, সেবা ও শিল্প—এই চার প্রধান খাতগুলোতেই সম্প্রসারণের গতি কমেছে। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, নভেম্বরে পিএমআই সূচক আগের মাসের তুলনায় ৭ দশমিক ৮ পয়েন্ট কমে ৫৪ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। অক্টোবরে পিএমআই সূচক ছিল ৬১ দশমিক ৮ পয়েন্ট।
তবে এ সময় সবচেয়ে খারাপ অবস্থান দেখা গেছে সেবা খাতের। কমেছে ১০ পয়েন্ট। এ ছাড়া শিল্প বা উৎপাদন খাতের গতি ৮ পয়েন্ট কমেছে। প্রতিবেদনে ভবিষ্যৎ ব্যবসা সূচকে, কৃষি, নির্মাণ ও সেবা খাতে গতি সম্প্রসারণের আশা করা হলেও উৎপাদন খাতের গতি সহসাই বাড়বে না বলেও পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
কৃষি, নির্মাণ, উৎপাদন ও সেবা—অর্থনীতির এই অন্যতম প্রধান চার খাতের ৪০০টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীদের মতামতের ভিত্তিতে পিএমআই প্রকাশ করা হয়। সূচক তৈরির ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কাঁচামাল ক্রয়, পণ্যের ক্রয়াদেশ, কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন তথ্য নেওয়া হয়। মূলত পিএমআই শূন্য থেকে ১০০ নম্বরের মধ্যে পরিমাপ করা হয়। সূচকের মান ৫০-এর বেশি হলে অর্থনীতির সম্প্রসারণ এবং ৫০-এর নিচে হলে সংকোচন বোঝায়। আর মান ৫০ থাকলে বুঝতে হবে সংশ্লিষ্ট খাতে ওই মাসে কোনো পরিবর্তন হয়নি।
ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের অন্যতম সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স (এমসিসিআই) ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশ যৌথভাবে পিএমআই প্রণয়ন করছে। সূচকটি প্রণয়নে সহযোগিতা দিয়ে থাকে যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কার্যালয় (এফসিডিও) ও সিঙ্গাপুর ইনস্টিটিউট অব পারচেজিং অ্যান্ড ম্যাটেরিয়ালস ম্যানেজমেন্ট (এসআইপিএমএম)।
চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে পিএমআই মান আগের মাসের তুলনায় বেড়ে ৬১ দশমিক ৫ পয়েন্টে উন্নীত হয়। কিন্তু আগস্টেই তা কমে ৫৮ দশমিক ৩ পয়েন্টে নামে। এরপর সেপ্টেম্বরে দশমিক ৮ শতাংশ বেড়ে ৫৯ দশমিক ১ পয়েন্টে উঠেছে। অক্টোবরেও কিছুটা বেড়ে ৬১ দশমিক ৮ পয়েন্টে উঠে আসে। সে হিসেবে টানা দুই মাস দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি সম্প্রসারণের গতি বেড়েছে। তবে নভেম্বরে তার ধারাবাহিক গতিতে ছেদ পড়ে, উল্টো ৭ দশমিক ৮ পয়েন্ট হ্রাস পায়।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সিইও ড. এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, ‘নভেম্বর মাসের পিএমআই থেকে বোঝা যায়, অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের গতি দুর্বল হয়ে এসেছে, যা বৈশ্বিক চাহিদা কমে যাওয়া ও রপ্তানি প্রতিযোগিতা হ্রাসের কারণে রপ্তানি খাতে চাপ, অভ্যন্তরীণ চাহিদার পতন এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে ব্যবসাগুলোর বিনিয়োগ স্থগিত রাখার প্রবণতার ফল। বার্ষিক রপ্তানি কমে গেলেও মাসওয়ারি বৃদ্ধি এবং কৃষি ফসল কাটার ধারাবাহিকতা সামগ্রিক সম্প্রসারণ বজায় রাখতে সহায়তা করেছে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, উৎপাদন খাত ছাড়া অন্যান্য সব খাতে ভবিষ্যৎ ব্যবসা সূচকের দ্রুততর সম্প্রসারণ লক্ষণীয়।