হোম > অর্থনীতি

হালাল বন্ডের বাজারে অনাস্থা

মাহফুজুল ইসলাম, ঢাকা

দেশে শরিয়াহভিত্তিক বিনিয়োগ পণ্য ‘সুকুক’ চালু হয়েছিল ইসলামি আর্থিক মূল্যবোধকে মাথায় রেখে। এটি এমন একটি পণ্য, যেখানে সুদ নেই, দুর্নীতি নেই আর ঝুঁকিও তুলনামূলক কম। অনেকে একে ‘হালাল বন্ড’ বলেও চেনেন। বিশ্বের বহু দেশে যেখানে ইতিমধ্যেই সুকুক বড় বাজার তৈরি করেছে, সেখানে একেবারেই ব্যতিক্রম বাংলাদেশে। গত পাঁচ বছরে এর আকার দাঁড়িয়েছে মাত্র ২২ হাজার ৩০০ কোটি টাকায়। এর মধ্যে করপোরেট পর্যায়ে এসেছে মাত্র ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, যদিও এসব সুকুকে বিনিয়োগকারীরা পেয়েছেন ৪.৬৫ থেকে ১০.৪০ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা।

সুকুক, একটি সম্ভাবনাময় আর্থিক পণ্য, দেশের মূলধারার বিনিয়োগে জায়গা পাচ্ছে না। এর পেছনে মূলত বাজারে অজ্ঞতা ও উদাসীনতার পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং নিয়ন্ত্রকদের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ দায়ী। বিশেষজ্ঞদের মতে, সুকুকের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত উজ্জ্বল। তবে অনাস্থা, অনিয়ম ও ধারণাগত দুর্ভাবনা এই পণ্যের সম্ভাবনা থামিয়ে রেখেছে।

সুকুক হলো শরিয়াহভিত্তিক একটি বিনিয়োগ পণ্য, যেখানে সুদের পরিবর্তে প্রকৃত সম্পদে অংশীদারির ভিত্তিতে মুনাফা দেওয়া হয়। মালয়েশিয়া বা আমিরাতের মতো দেশে এটি প্রকল্পে মালিকানা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো এটি মূলত প্রকল্প সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য তৈরি একটি বন্ড হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে, ফলে সাধারণ ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ খুবই সীমিত।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেটস (বিআইসিএম)-এর সহকারী অধ্যাপক এস এম কালবীন ছালিমা এ বিষয়ে আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিনিয়োগকারীর অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো পণ্যই জনপ্রিয় হতে পারে না। সুকুক সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার ও বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগ জরুরি।

বিশ্বে যেখানে বন্ড মার্কেটের আকার ১৩৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি, সেখানে ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক সুকুকের বাজার রয়েছে ১.৭ ট্রিলিয়ন ডলার। অথচ বাংলাদেশে পুরো বন্ড মার্কেটের (ট্রেজারি ও করপোরেট) আকারই হচ্ছে মাত্র ২ লাখ ১৯ হাজার ৬০০ কোটি বা ২.১৯৬ ট্রিলিয়ন টাকা। সেই তুলনায় সুকুকের অংশ এমনই নগণ্য যে পুরো বাজারে এর অবস্থান প্রায় অদৃশ্য।

সরকার ২০২০ সালে প্রথমবার সুকুক ইস্যুর মাধ্যমে ‘সেভ ওয়াটার সাপ্লাই টু দ্য হোল কান্ট্রি’ প্রকল্পে ৮ হাজার কোটি টাকা অর্থায়ন করে, যা ৫ বছর মেয়াদি এবং ৪.৬৯ শতাংশ মুনাফা প্রদান করেছে। পরবর্তী সময়ে ‘নিড বেইজ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট অব গভর্নমেন্ট প্রাইমারি স্কুল’ এবং ‘আইআরআইডিপি-৩’ প্রকল্পে যথাক্রমে ৫ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়। সবচেয়ে উচ্চ মুনাফার প্রকল্প ছিল ‘সিডব্লিউএসপি সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট প্রজেক্ট’, যেখানে ১০.৪০ শতাংশ রিটার্ন দিয়েছে। তবে ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীরা এখনো ২ শতাংশের নিচে আগ্রহ দেখাচ্ছেন এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও মূলত বাধ্যবাধকতার কারণে অংশ নিচ্ছেন।

অন্যদিকে বাংলাদেশে করপোরেট সুকুকের যাত্রা শুরু হয় বেক্সিমকোর ‘গ্রিন সুকুক আল ইসতিসনা’র মাধ্যমে, যার মাধ্যমে তারা বাজার থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করে এবং ৯ শতাংশ হারে মুনাফা দেয়। পরে বঙ্গ বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালস লিমিটেড (বিবিএমএল) ৩০০ কোটি টাকার সুকুক ইস্যু করে, যেখানে মুনাফার হার ছিল ৮ থেকে ১১ শতাংশের মধ্যে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সরকারের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বর্তমানে সুকুক ইস্যুর জন্য আবেদন করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘পল্লী সড়কে গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণ প্রকল্প’, যার জন্য ৩ হাজার কোটি টাকার সুকুক ছাড়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ তৎপরতা শুরু হয়েছে। ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ১০ বছর মেয়াদি ১ হাজার কোটি টাকার ‘আইসিবি ফার্স্ট মুদারাবা সুকুক’ ইস্যুর প্রস্তুতি নিচ্ছে, আর দেশবন্ধু পলিমার লিমিটেডও ৫০০ কোটি টাকার সুকুক ইস্যু করতে যাচ্ছে।

বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সুকুক শরিয়াহসম্মত পণ্য এবং বাংলাদেশের ব্যাংক ও বিমা প্রতিষ্ঠানগুলো এতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। ইসলামিক অর্থনীতির বিস্তারে এটি হতে পারে সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে সুকুক জনপ্রিয় করতে হলে রিটেইল পর্যায়ে এটি আরও সহজবোধ্য ও আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। দেশের ৯০ শতাংশ মুসলমানের জন্য সুদমুক্ত আয়ের আকর্ষণ থাকলেও সুকুক সম্পর্কে সঠিক বার্তা এখনো তাদের কাছে পৌঁছায়নি। বিআইসিএমের মতে, সুকুকের ধারণা ছড়িয়ে দিতে শিক্ষা পাঠ্যক্রমেই এর অন্তর্ভুক্তি জরুরি।

সুকুকের টেকসই বিকাশে দরকার একটি স্বাধীন, জবাবদিহিমূলক এবং শরিয়াহ-পরিপালন নিশ্চিতকারী নিয়ন্ত্রক কাঠামো। অতীতে পক্ষপাতদুষ্ট ইস্যুগুলোর কারণে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে। তাই বন্ডের বিকল্প হিসেবে সুকুককে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে ‘এসআরআই’, ‘রিটেইল’, ‘ব্লু’ ও ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল’ সুকুকের মতো উদ্ভাবনী মডেল চালু করতে হবে।

সুকুক বিনিয়োগের সম্ভাব্য ক্ষেত্র প্রসঙ্গে বলা যায়, পেনশন ফান্ড, সভরেন ওয়েলথ ফান্ড, ফান্ড ম্যানেজার, কমার্শিয়াল ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স কোম্পানি, মিউচুয়াল ফান্ড, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং ব্যক্তি বিনিয়োগকারী—সবার জন্যই এটি উপযোগী। কারণ এই বিনিয়োগ শরিয়াহ সুপারভাইজারি বোর্ডের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত, ঝুঁকিমুক্ত এবং সামাজিক কল্যাণমুখী খাতে ব্যয় হয়।

এখন প্রশ্ন একটাই—এত সম্ভাবনা, এত মুনাফা, এত শুদ্ধতা থাকার পরও কেন এই খাত আজও প্রান্তিক, অবহেলিত, অবিশ্বাসে ঢাকা? উত্তর খুঁজতে গেলে বারবার ফিরে যেতে হয় পরিচালনার স্বচ্ছতা, নিয়ন্ত্রণকাঠামোর জবাবদিহি এবং রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছার জায়গাটিতে।

অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় বাড়ল আরও এক মাস

তুলা গবেষণা কেন্দ্রের ফুটি কার্পাসে নতুন সম্ভাবনা

১ জানুয়ারি কার্যকর: দেশের সব স্থলবন্দরের মাশুল বাড়ল ৫ শতাংশ

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর: ফসল ব্যবস্থাপনায় উত্তরের চার জেলায় কৃষির নতুন প্রকল্প

বিশেষ ট্রাইব্যুনাল যেন গুদামঘর

কক্সবাজারে এমজিআইয়ের বার্ষিক সেলস কনফারেন্স

ষষ্ঠবারের মতো এইচএসবিসি এক্সপোর্ট এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড পেল ডিবিএল গ্রুপ

আরও কমেছে পেঁয়াজ আলু ও সবজির দাম

জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থীদের ই-রিটার্ন দাখিলে এনবিআরের হেল্প ডেস্ক

আকাশপথে পণ্য পরিবহনে অফডক চান ব্যবসায়ীরা