মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ঘূর্ণিঝড়ে তছনছ হয়ে গেছে বিধবা মুক্তা বেগমের (৪৫) জীবন। ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে ভেঙে গেছে তাঁর টিনের ঘর। ভেঙে গেছে ঘরের আসবাবপত্র। ঘরের অনেক জিনিসপত্র বাতাসের দাপটে উড়ে গিয়ে পড়েছে দূরের কোনো জায়গায় কিংবা পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। এই ঘূর্ণিঝড়ে তাঁর আয়-রোজগার করে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন সেলাই মেশিনটিও ভেঙে গেছে।
মুক্তা বেগমের বাড়ি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার আলমবিদিতর ইউনিয়নের খামার মোহনা গ্রামে। চার বছর আগে দিনমজুর স্বামীর মৃত্যুর পর তিন মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে ঋণের বোঝায় ডুবে যান তিনি। সংসার চালাতে ধারদেনা করে একটি পুরোনো সেলাই মেশিন কিনেছিলেন মুক্তা বেগম। এই মেশিনে পরিচিতজনদের কাপড় সেলাই করে কোনোমতে দুমুঠো ভাতের সংস্থান করছেন তিনি। সেলাই মেশিনটি ছিল তাঁর জীবনসংগ্রামের অবলম্বন।
গত রোববার (৫ অক্টোবর) সকালে গঙ্গাচড়ায় ঘূর্ণিঝড় তাণ্ডব চালায়। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের সেই ঝড়ে খামার মোহনা গ্রামে মুক্তা বেগমসহ আরও অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
আজ বুধবার সকালে মোহনা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মুক্তা বেগম ভাঙা ঘরের সামনে সেলাই মেশিনটি নিয়ে বসে আছেন। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী মরার পর কত কষ্ট করে মেয়েগুলারে বিয়া দিছি। এই সেলাই মেশিনটা দিয়া কোনো রকমে জীবনটাত পানি দিছিলাম, ভাবছিলাম অন্তত আর কারও কাছোত হাত পাতি খাওয়া নাগবে না। কিন্তু আল্লাহ, আমার কপালে তা-ও সইল না। ঘর তো গেলই, এখন কাজ করে খাওয়ার যন্ত্রটাও নাই। খোলা আকাশের নিচে উড়ে যাওয়া ঘরত চার দিন ধরি এভাবে আছুং।’ মুক্তা বেগমের ৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধ মা মোমেনা বেগম এসে হাতজোড় করে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলছেন, ‘মোর এই হতভাগিটার দুনিয়াত কায়ও নাই, জাদুটা এখন কেমন করি চলবে, কোনো উপায় খুঁজি পায় চোল না। আইজ সারা রাইত কান্দি গেইছে। কেমন করি এই ঘর তুলবে। এতগুলা টাকায় কোনটে পাইবে। তোরা একনা সহযোগিতা করেন, আল্লাহ তোমার ভালো করবে।’
এ সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড়ে খামার মোহনা গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলামও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সাত বছর আগে তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন। ১০ বছরের নাতিকে নিয়ে তাঁর ছোট সংসার। ঘূর্ণিঝড়ে তাঁর টিনের ঘরটি উড়ে গেছে। নজরুল ইসলাম (৬৩) আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কিছু টিন-কাঠ খুঁজে পাইছি, কিন্তু বেশির ভাগই নাই। এইটুকু নাতিকে নিয়ে এখন কোথায় যাব? আজ সকাল থাকি না খেয়া আছি, সরকারি সাহায্য ছাড়া আমাদের বাঁচার আর কোনো উপায় নেই।’
একই গ্রামের বাসিন্দা মোজাম্মেল হক। তিনি পাশের এলাকা থেকে একটি বকনা গরু বর্গা নিয়ে লালনপালন করতেন। সেদিনের ঘূর্ণিঝড়ে ঘর ভেঙে পড়লে গরুটি ঘরের ভেতরেই মারা যায়।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সেদিনের ঘূর্ণিঝড়ে আলমবিদিতর ও নোহালী ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের প্রায় ৮৩৩ পরিবারের ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এসব ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে ১৬০ প্যাকেট শুকনা খাবার ও ১৪ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহামুদুল হাসান মৃধা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের গঙ্গাচড়া উপজেলায় গত ৫ তারিখে ঘূর্ণিঝড় ও টর্নেডো যে আঘাত হেনেছে, সেটার পরিপ্রেক্ষিতে সব মিলিয়ে প্রায় ১ হাজার ২০০ পরিবার এই উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের পক্ষ থেকে আমরা ১ হাজার ২০০ পরিবারের মাঝে ৪০ টন চাল এবং নগদ ২ লাখ টাকা বিতরণ করেছি। এ ছাড়া ২০০ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া আমরা ঢেউটিন, নগদ অর্থ ও চালের জন্য বরাদ্দ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠিয়েছি। আমরা আশা করছি, সেটা পেলে বাকি যে পরিবারগুলো রয়েছে, তাদের পুনর্বাসনের জন্য কার্যক্রম সম্পন্ন করতে পারব।’