১৭ বছর কারাবাস শেষে অবশেষে স্বজনদের কাছে ফিরেছেন বিডিআর সদস্য নজরুল ইসলাম। গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ৭টায় নাটোর কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। পরে রাত ৯টার দিকে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউসা ইউনিয়নের দিঘা গ্রামের নিজ বাড়িতে পৌঁছান। মৃত ফজলুল হকের তিন ছেলের একজন নজরুল; তাঁদের পরিবারে তিন ভাই ও পাঁচ বোন।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার এই ঘরে ফেরা আনন্দের নয়, কান্নায় ভেঙে পড়ে শুরু হয় তাঁর ফিরে আসার গল্প। কারণ, তিন বছর আগে না ফেরার দেশে চলে গেছেন তাঁর স্নেহের বড় ছেলে জাবির আল নাহিদ। যাকে রেখে তিনি কারাগারে গিয়েছিলেন, যার জন্য বুকে হাজারো স্বপ্ন ধারণ করেছিলেন, তারই মুখ আর দেখা হলো না। শুধু ছেলেই নয়, কারাগারে থাকতে একের পর এক কাছের মানুষের মৃত্যুসংবাদ পেয়েছেন তিনি।
জানা গেছে, ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পিলখানা বিডিআর বিদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে নজরুল ইসলামের দীর্ঘ কারাজীবন শুরু হয়। ঘরে রেখে গিয়েছিলেন দুই সন্তান শাপলা ও নাহিদ হোসেনকে। বাবার অনুপস্থিতিতে তাঁর দুই সন্তান নিজেদের মতো করে বাবার স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করছিলেন। নাহিদ ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করতেন। কিন্তু বাবার ফেরার অপেক্ষা অপূর্ণ রেখে হঠাৎ কর্মস্থলে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান তিনি। এদিকে মেয়ে নাসরিন নাহার শাপলা এখন বিবাহিত। বাবা মুক্তি পেয়েছেন, এই আনন্দ থাকলেও ভাইকে হারানোর বেদনা আজও বুকের ভেতর রয়ে গেছে।
বাড়ির উঠানে পা রাখতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন নজরুল। পাশে থাকা স্ত্রী, স্বজন ও প্রতিবেশীরা কান্না থামাতে পারেননি। কিন্তু সেই আবেগঘন মুহূর্ত একসময় থমকে যায় ছেলের অনুপস্থিতির হাহাকারে। ‘২৬ বছর চাকরি করে কী অপরাধ করেছিলাম? কাপ্তাইয়ে চাকরি করে পুরস্কার নিতে ডাকায় পিলখানায় গিয়েছিলাম। এরপর বিনা অপরাধে ১৭ বছর জেল খাটলাম। যদি সঠিক বিচার হতো, এত কষ্ট পেতে হতো না।’ ভাঙা গলায় এভাবেই বলছিলেন নজরুল ইসলাম। নজরুল আরও বলেন, ‘পরিবারের কাছে ফিরলাম ঠিকই, কিন্তু স্নেহের সন্তানের মুখ আর দেখতে পারলাম না। কারাগারের ভেতর থেকে তার মৃত্যুসংবাদ পাওয়া—সেই যন্ত্রণা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়।’
মুক্তির পর গ্রামে প্রবেশ করতেই শত শত মানুষ ছুটে আসেন নজরুলকে দেখতে। কেউ তাঁর হাত ধরে কাঁদছেন, কেউ নীরবে তাকিয়ে রয়েছেন হারানো সময়ের প্রতিচ্ছবি হয়ে। পুরো গ্রাম ভরে ওঠে আবেগ ও কান্নায়। কিন্তু মানুষের ভিড়ের মাঝেও নজরুল ইসলামের চোখে লুকানো থাকে অপূরণীয় বেদনার ছায়া—সন্তান আর কোনো দিন ‘বাবা’ বলে ডাকবে না। স্বজনদের ভালোবাসা তাঁর যন্ত্রণা কিছুটা লাঘব করলেও নাহিদের অকালমৃত্যু তাঁর জীবনে তৈরি করেছে গভীর এক ক্ষত, যা হয়তো কোনো দিনই পূরণ হবে না।
নজরুল ইসলামের স্ত্রী জেসমিন নাহার বেণু কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘১৭ বছর পর আমার স্বামী ঘরে ফিরেছে। এই দিনের জন্য কত অপেক্ষা করেছি, তা কাউকে বোঝাতে পারব না। কিন্তু আমাদের সন্তান আর বেঁচে নেই। হার্ট অ্যাটাকে ওকে হারালাম। বাবাকে দেখতে পারল না। তবু আল্লাহর কাছে শোকরিয়া, অন্তত স্বামীকে জীবিত ফিরে পেয়েছি। এখন আমাদের একটাই চাওয়া—আর কোনো পরিবার যেন এমন অন্যায়ের শিকার না হয়।’
নজরুল ইসলাম সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘যাঁরা এখনো কারাগারে নিরপরাধ অবস্থায় আছেন, যাঁদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে, তাঁদের যেন দ্রুত মুক্তি দেওয়া হয়। তাঁদের জীবন যেন আমার মতো তিলে তিলে নষ্ট না হয়।’