স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের পর যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (যবিপ্রবি) ক্যাম্পাস এবং ঘটনাস্থল আমবটতলা মোড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। আজ বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকলেও হয়নি কোনো ক্লাস-পরীক্ষা। ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের পদচারণাও ছিল কম। এদিকে শিক্ষার্থীকে উত্ত্যক্তের অভিযোগে দোকানদার মুনায়েম হোসেনকে আটক করেছে পুলিশ।
বিশ্ববিদ্যালয়, পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত সোমবার যবিপ্রবির এক নারী শিক্ষার্থী আমবটতলা বাজারে মুনায়েম হোসেনের মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকানে যান। দোকানদার ওই শিক্ষার্থীকে উত্ত্যক্ত করেন। বিষয়টি নারী শিক্ষার্থী তাঁর সহপাঠীদের জানালে গতকাল মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) সন্ধ্যায় দোকানদারকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে যান তাঁরা। একপর্যায়ে দোকানদারের সঙ্গে তাঁদের বাগ্বিতণ্ডা হয় এবং শিক্ষার্থীরা দোকানদারকে মারধর করেন।
এর জেরে দোকানদারেরা একত্র হয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান। সংঘর্ষের একপর্যায়ে তাঁরা মাইকে ঘোষণা দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার জন্য এলাকাবাসীকে ডাকেন। এ সময় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এতে ক্যাম্পাস এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই সাংবাদিকসহ আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ শিক্ষার্থী। ক্যাম্পাসের এক সাংবাদিকের সাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ ও প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে উভয় পক্ষকে শান্ত করার চেষ্টা করেন।
রাত ৯টার পর সেনা ও পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনের। ঘটনার পর ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা দ্রুত বিচারের দাবিতে চৌগাছা–যশোর সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঘটনাস্থলে দেরিতে পৌঁছানোয় ক্ষোভ জানিয়ে শিক্ষার্থীরা উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল মজিদ ও কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. হোসাইন আল মামুনের পদত্যাগের দাবিতে প্রায় চার ঘণ্টা তাঁদের অবরুদ্ধ করে রাখেন। পরে রাত দেড়টার দিকে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আশ্বাস দিলে শিক্ষার্থীরা উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষকে ছেড়ে দেন।
সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা প্রক্রিয়াধীন বলে জানিয়েছে পুলিশ। শিক্ষার্থীকে উত্ত্যক্তের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা করেছেন।
এদিকে ঘটনার পর থেকে বাজারের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। অনেকে গ্রেপ্তার আতঙ্কে দোকানপাট বন্ধ রেখেছেন। ক্যাম্পাস কিংবা বাজারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন না থাকলেও পুলিশের টহল অব্যাহত রয়েছে। স্থানীয় চুড়ামনকাটি ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য আব্দুল মান্নান বলেন, ভার্সিটির শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে এককাট্টা গ্রামবাসী। অনেক শিক্ষার্থী আমবটতলায় এসে চা খেয়েও টাকা দেন না, বরং ঝাড়ি মারেন। বাজারের এক দোকানদারকে শিক্ষার্থীরা মেরেছেন, সেটার প্রতিবাদ করায় ছাত্ররা আগে হামলা করেছেন। ঘটনার পর যে দোকানদারের সঙ্গে বিরোধ ছিল, পুলিশ তাঁকে আটক করেছে। এখন বাজারে গ্রেপ্তার আতঙ্ক বিরাজ করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, উত্ত্যক্তের বিষয়টি জানতে পেরে তাঁরা দোকানদারের কাছে প্রশ্ন করতে গেলে স্থানীয় বাসিন্দাদের বড় একটি দল তাঁদের ওপর হামলা চালায়। শিক্ষার্থীরা দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে পেছন থেকে ইট নিক্ষেপ করা হয়।
আজ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত যবিপ্রবির ক্যাম্পাসে দেখা যায়, ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের পদচারণা অনেক কম। ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকলেও প্রশাসনিক কার্যক্রম চলছে। আহত শিক্ষার্থীদের কয়েকজন ক্যাম্পাসের আর এম খান মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আবার কয়েকজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য যশোর জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। আজ হাটের দিন হলেও সংঘর্ষের ঘটনাস্থল আমবটতলা বাজারের অধিকাংশ দোকান বন্ধ রয়েছে। সড়কের ওপর বিক্ষিপ্তভাবে ইটপাটকেল পড়ে রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন দোকানদার বলেন, ‘কোনো দোকানদার চান না শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঝামেলা করতে। কারণ, শিক্ষার্থীরাই এসব দোকানদারের ক্রেতা। কিন্তু শিক্ষার্থীরা দুই দফা এক দোকানদারকে মারধর করেছেন। আমরা মুনায়েমের পক্ষে ক্ষমা চেয়েছি। তারপরেও মারধর করায় দোকানদারেরা ক্ষিপ্ত হয়ে যায়।’
কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা ক্যাম্পাসের বাইরে যেতে পারছি না। আমবটতলায় গেলে তারা আমাদের ওপর হামলা চালাতে পারে। আমরা নিরাপত্তার শঙ্কায় রয়েছি।’
এ বিষয়ে যবিপ্রবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল মজিদ বলেন, ‘আমাদের প্রক্টরিয়াল বডিসহ অনেক শিক্ষক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আসতে দেরি করায় পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যায়। সংঘর্ষে আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থী আতঙ্কিত ও আহত। তাই আজ ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ রাখা হয়েছে। শনিবার থেকে নিয়মিত ক্লাস চলবে।’ উপাচার্য আরও বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ওপর এলাকাবাসীর হামলা নিন্দনীয়। আমরা বিষয়টি নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং বাজার কমিটির সঙ্গে বসে এ ধরনের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে বিষয়ে আলোচনা করব।’
যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবুল বাশার বলেন, এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। একটি মামলায় অভিযুক্ত দোকানিকে আটক করা হয়েছে। কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে আটক করা হবে না। ঘটনাস্থলে পুলিশ টহল অব্যাহত রেখেছে।