তেজগাঁও ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার থেকে যে খাবার দেওয়া হয়েছে, তা কোনো দিন চোখেও দেখেনি দুই জাপানি শিশু মালিকা ও লিনা। তবুও সেসব খাবারই তাদের খেতে হচ্ছে। এসি ছাড়া ঘুমানোর অভিজ্ঞতাও তাদের কাছে নতুন। যে শৌচাগার আছে, তাও ব্যবহারে অনভ্যস্ত তারা। তার সঙ্গে আছে জেলখানার মতো বন্দী পরিবেশ। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের পরিবেশ বাচ্চাদের মনে মানুষ ও সমাজ নিয়ে বিষণ্ণতা তৈরি করতে পারে।
জেসমিন মালিকা ও মাকানো লাইলা লিনা নামের দুই জাপানি শিশু আছে তেজগাঁওয়ের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে। মা-বাবার বিরোধের শিকার হওয়ার পর আদালত তাদের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে এই সময়ে তাদের বাঙালি বাবা ও জাপানি মা দিনে পাঁচ ঘণ্টা করে তাদের সঙ্গে কাটাতে পারবেন।
এভাবে দুই শিশুকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখা নিয়ে কথা হয় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মুনতাসীর মারুফের সঙ্গে। তিনি বলেন, মা-বাবার মধ্যকার টানা-পড়েনের ফলে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য এমনিতেই ঝুঁকির মধ্যে। তারপর যদি থানা-পুলিশ হয়ে অচেনা পরিবেশে থাকতে হয়, সেটা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এ ধরনের শিশুর মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
দুই শিশুর পিতা শরীফ ইমরান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে আসার পর তাঁর সন্তানেরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সেখানে যেসব খাবার দেওয়া হচ্ছে, তা তারা কোনো দিন মুখে তোলেনি।
দুই শিশুর এই পরিস্থিতির জন্য আপনি ও আপনার স্ত্রী দায়ী কি না প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে তিনি সব মানিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চলতি বছরের শুরুর দিকে তাঁকে বাসা থেকে বের দেন স্ত্রী। এরপর দুই মেয়েকে নিয়ে তিনি চলে আসেন ঢাকায়।
কাগজপত্র জাল করে মেয়েদের নিয়ে আসা হয়েছে, জাপানি নারীর আইনজীবীর অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, তিনি কোনো কাগজ জাল করেননি। বৈধ উপায়ে দুই সন্তানকে জাপান থেকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছেন। ইমরান শরীফ দাবি করেছেন, স্ত্রীকে তিনি ডিভোর্স দেননি। তাঁর স্ত্রী এরিকোই তাঁকে ডিভোর্স দিয়েছেন।
এদিকে, জাপানি দুই শিশুকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তেজগাঁওয়ের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে উন্নত পরিবেশে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত জাপানি মা ও বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বাংলাদেশি বাবা শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতে পারবেন। ৩১ আগস্ট শিশুদের হাইকোর্ট হাজির করতে হবে।
গত সোমবার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতে শিশুদের বাবার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী ফাওজিয়া করিম। জাপানি মায়ের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির।
সোমবার সকালে আদালতের আদেশে হাজির করার নির্ধারিত দিনের আগেই জাপানি দুই শিশুকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নেওয়ার ঘটনাটি হাইকোর্টের নজরে আনেন তাদের বাবার আইনজীবী ফাওজিয়া করিম।
গত বৃহস্পতিবার দুই জাপানি শিশু জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনা এবং তাদের বাবা শরীফ ইমরানকে এক মাসের জন্য দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে দুই শিশুকে ৩১ আগস্ট আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মুক্তা ধর গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘আমাদের কাছে তথ্য ছিল আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী দুই সন্তানকে ৩১ আগস্ট আদালতে হাজির করা হবে না। এ জন্য আমরা তাদের উদ্ধার করে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঠিয়েছি। দুই সন্তান কার কাছে থাকবে আদালতই তা সিদ্ধান্ত দেবেন।’ সিআইডি এখানে অতি উৎসাহী কোনো ভূমিকা পালন করছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা কারও কাছে সন্তানদের হস্তান্তর করছি না।’
জানা গেছে, নাকানো এরিকো (৪৬) পেশায় একজন চিকিৎসক। এরিকোর সঙ্গে ২০০৮ সালে বাংলাদেশি-আমেরিকান নাগরিক ইমরানের (৫৮) বিয়ে হয়। জাপানি আইন অনুযায়ী বিয়ের পর তাঁরা টোকিওতে বসবাস শুরু করেন। তাঁদের তিনটি সন্তান—জেসমিন মালিকা (১১), মাকানো লাইলা লিনা (৯) ও সানিয়া হেনা (৬)। চলতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি শরীফ ইমরান তাঁর দুই কন্যা জেসমিন মালিকা ও মাকানো লাইলা লিনাকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। গত ১৮ জুলাই নাকানো এরিকোও তাঁর সন্তানদের জাপানে ফিরিয়ে নিতে ঢাকায় আসেন।