রাস্তার ওপরে নয়, এনসিপি নেতা মোতালেব শিকদারকে গুলি করা হয়েছে একটি ফ্ল্যাটের ভেতরে। সেখানে এক নারীসহ কয়েকজন নেশাদ্রব্য পান করছিলেন। কোনো একটি বিষয়ে মতবিরোধ হওয়ায় মোতালেবকে গুলি করা হয়। ওই ফ্ল্যাট থেকে মদ, ইয়াবা, গুলির খোসা, রক্তমাখা কাপড়সহ বেশ কিছু আলামত উদ্ধার করেছে পুলিশ। বর্তমানে ওই ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া তন্বী নামের এক নারীকে খুঁজছে পুলিশ।
আজ সোমবার দুপুর পৌনে ১২টার দিকে সোনাডাঙ্গা থানাধীন আল আকসা মসজিদ সরণির ১০৯ নম্বর রোডের মুক্তা হাউসের নিচতলায় এ ঘটনা ঘটার পর পুলিশ, সিআইডি, র্যাব ও যৌথ বাহিনীর প্রাথমিক তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে। তবে ঘটনার পরপরই প্রচার করা হয়, মোতালেবকে একটি চায়ের দোকানে মারধর করার পর গুলি করা হয়। তবে পরে আসল ঘটনা প্রকাশ পায়।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত কেএমপির উপপুলিশ কমিশনার মোহাম্মাদ তাজুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আজ সকালে আমরা তথ্য পেয়েছি এনসিপির একজন গাজী মেডিকেলের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। সত্যতা যাচাই করার জন্য ঘটনাস্থলে আসি। ঘটনাস্থল ও সাক্ষী খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পরে এনসিপির ভিকটিমের প্রাইভেট কার পড়ে থাকতে দেখে সন্দেহ হয়, আশপাশে কোথাও হয়েছে।’
উপপুলিশ কমিশনার বলেন, ‘তখন লাজফার্মা থেকে আমরা একটি ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করি। রাত সাড়ে ১২টার দিকে ভিকটিমসহ আরও দুজন এখানে আসে এবং কোথাও অবস্থান করে। সেই ডকুমেন্টস খুঁজতে খুঁজতে আমরা এখানে (তন্বীর ফ্ল্যাট) আসি। মুক্তা হাউসের নিচতলার ওই কক্ষ থেকে আমরা মাদকের বিভিন্ন উপকরণ উদ্ধার করি। এখানে মেয়েদের নিয়ে এসে ফুর্তি করা হতো বলে আমরা জানতে পেরেছি।’
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা মুক্তা হাউস নামের বাড়িতে এসে দেখতে পাই, ঘটনাস্থল এখানেই। এখানে বিভিন্ন স্থানে আমরা রক্তের দাগ পেয়েছি। ঘরটিতে ঢোকার পর আমরা দেখতে পাই, সেখানে মাদকের ছড়াছড়ি। বিদেশি মদের বোতল, ইয়াবা সেবনের সরঞ্জাম এবং সেখানে আমরা একটি গুলির খোসাও পেয়েছি। একটি বিষয় আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে এখানে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অন্তঃকোন্দলের কারণে গুলির ঘটনাটি ঘটেছে।’
কেএমপির উপপুলিশ কমিশনার মোহাম্মাদ তাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘গতকাল রোববার রাতে মোতালেব শিকদার এখানে এসেছিল এবং এখানে বিভিন্ন ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ করেছে। তাদের নিজেদের মধ্যে কোন্দলের কারণে এ গুলির ঘটনা ঘটেছে, যেটা আমরা প্রাথমিক তদন্তে পেয়েছি। এর সঙ্গে আরও অনেকে জড়িত আছে। মোতালেবকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আমরা অন্যদের নাম জানতে পারব। যারা জড়িত আছে, তাদের খুব শিগগির আইনের আওতায় আনতে পারব। গুলিটি তার ভেতরে ঢোকেনি, চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। মোতালেব এখন শঙ্কামুক্ত।’
সূত্র জানায়, রাতে তন্বী নামের একটি মেয়ের ওই ফ্ল্যাটে মোতালেব শিকদারের সহযোগীরা ইয়াবা সেবন, মদ্যপান ও মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করেছিলেন। নিজেদের মধ্যে মতবিরোধের কারণে সহযোগীর কেউ একজন তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি করেন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তিনি রিকশাযোগে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যান বলে পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়। ঘটনার পর থেকে ওই ফ্ল্যাটের ভাড়াটে তন্বীর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁকে খুঁজছে পুলিশ।
জানতে চাইলে মসজিদ সরণি রোডের মুক্তা হাউসের মালিকের স্ত্রী আশরাফুন্নাহার বলেন, ‘স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে তন্বী নামের এক তরুণী এক মাস (ডিসেম্বরের ১ তারিখ) আগে নিচের ফ্লোরটি ভাড়া নেয়। সে নিজেকে এনজিও কর্মী হিসেবে দাবি করে প্রায় সময় বাড়ির বাইরে থাকত। তার কক্ষে একাধিক পুরুষের আসা-যাওয়া ছিল। পরে অন্যদের মাধ্যমে তার অসামাজিক কার্যকলাপের বিষয়টি জানতে পেরে এ মাসে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিই। কিন্তু বাড়ির ছাড়ার আগেই এ ঘটনা ঘটেছে।’
এদিকে ছেলের ওপর গুলির ঘটনা জানতে পেরে হাসপাতালে ছুটে যান মোতালেবের মা রাবেয়া বেগম, স্ত্রী ফাহিমা আক্তার ও তিন বছরের কন্যাসন্তান। সেখানে তাঁরা এ প্রতিবেদককে জানান, গতকাল সন্ধ্যায় মোতালেবের সঙ্গে সর্বশেষ মোবাইলে কথা হয়। মোতালেব তাঁদের জানান, খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে তাঁদের একজন কর্মী আহত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাঁর সার্বিক খোঁজখবর নেওয়ার জন্য তিনি খুমেক হাসপাতালে আছেন। এরপর ডাকবাংলো মোড়ে স্যান্ডেল কেনার জন্য যাবেন। এ কথা বলে মোতালেব ফোন কেটে দেন। রাতে আর কোনো কথা হয়নি তাঁর সঙ্গে। বেলা ১১টার দিকে একজন ফোন করে জানায়, তাঁকে গুলি করা হয়েছে। তাঁরা আরও জানান, জাতীয় নাগরিক পার্টিতে যোগ দেওয়ার কারণে প্রতিপক্ষ তাঁকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা চালায়।
খুমেক হাসপাতালে উপস্থিত এনসিপির খুলনা মহানগর সংগঠক আহম্মেদ হামীম রাহাত জানান, সোনাডাঙ্গা এলাকায় মোতালেব শিকদারকে গুলি করা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁকে উদ্ধার করে খুমেক হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানেই তিনি চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
হামীম রাহাত ক্ষোভ প্রকাশ করে আরও বলেন, খুলনা সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। বিগত দিনে খুলনায় অহরহ গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। আর এসব সন্ত্রাসী গ্রুপই আওয়ামী নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট। নিষিদ্ধ সংগঠন আওয়ামী নেতাদের মদদেই সন্ত্রাসীরা খুলনাকে অশান্ত করার মিশনে নেমেছে। তিনি অবিলম্বে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন।
এনসিপির খুলনা জেলা প্রধান সমন্বয়কারী মাফুজুল হাসান ফয়জুল্লাহ এ ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগকে সরাসরি দায়ী করে বলেন, মোতালেব সার্জিক্যাল হাসপাতালের সামনে গাড়ি থেকে নামার পর তাঁকে টেনেহিঁচড়ে একটি চায়ের দোকানে নিয়ে মারধর করার পর গুলি করা হয়। তবে তাঁর এ বক্তব্যের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে খুমেক হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক হারুন অর রশিদ বলেন, গুলিটি তাঁর বাম কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। খুলনা সিটি ইমেজিং সেন্টারে তাঁর মাথার স্ক্যান করা হয়েছে। সেখানে মাথায় গুলির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। আহত মোতালেব মিয়া এখন শঙ্কামুক্ত।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গুলিবিদ্ধ মোতালেব আগে শ্রমিক লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সরকার পরিবর্তনের পরে তিনি এনসিপির শ্রমিক সংগঠন জাতীয় শ্রমিক শক্তির সঙ্গে যুক্ত হন। তিনি একজন ট্রাক ড্রাইভার।