ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে মার্কিন নৌবাহিনীর উপস্থিতি বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে চড়া হচ্ছে রাজনৈতিক বক্তব্য। এমন পরিস্থিতিতে ভেনেজুয়েলার ওপর সম্ভাব্য মার্কিন সামরিক হামলার আশঙ্কা ক্রমে ঘনিয়ে আসছে।
ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটির (ডিএইচএস) তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে ভেনেজুয়েলায় মাদক পাচারের অভিযোগে অন্তত ২১টি নৌযানে মার্কিন সামরিক বাহিনী হামলা চালিয়েছে, যাতে অন্তত ৮৭ জন নিহত হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব নৌকা যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করছিল এবং তা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, কোকেনসহ মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর প্রধান উৎস ভেনেজুয়েলা নয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কখনো বলেছেন, ভেনেজুয়েলার ভেতরে স্থল অভিযান বিবেচনায় নেই, আবার কখনো বলেছেন, তিনি তা বাতিলও করছেন না। তবে তিনি সিআইএকে ভেনেজুয়েলার ভেতরে কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দিয়েছেন।
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো দাবি করছেন, ট্রাম্পের উদ্দেশ্য হলো তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরানো। তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন, তাঁর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের সব চেষ্টা প্রতিহত করবে।
ভেনেজুয়েলায় মার্কিন হামলা কীভাবে হতে পারে
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের হাতে ভেনেজুয়েলাকে লক্ষ্য করে একাধিক সামরিক বিকল্প রয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই স্থলবাহিনীর পরিবর্তে বিমান ও নৌশক্তি ব্যবহার করা হতে পারে।
সাম্প্রতিক মাসগুলোয় যুক্তরাষ্ট্র ক্যারিবিয়ান সাগরে নৌ ও বিমানবাহিনীর উপস্থিতি বাড়িয়েছে। এর মধ্যে আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস জেরাল্ড ফোর্ড।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইসি) উপদেষ্টা এবং সাবেক মেরিন কর্নেল মার্ক ক্যানসিয়ান আল জাজিরাকে বলেন, বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সব প্রস্তুতি নেওয়া আছে। তবে ভেনেজুয়েলার শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থার কারণে প্রথম হামলা সম্ভবত দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হবে।
ট্রাম্প প্রশাসন সাম্প্রতিক বক্তব্যে মাদুরো সরকারের সঙ্গে কথিত ড্রাগ কার্টেল-সংযোগের কথা বলছে। বিশ্লেষকদের মতে, মাদকসম্পর্কিত অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালালে আন্তর্জাতিকভাবে সহজেই এটিকে ন্যায্যতা দেওয়া যাবে এবং দ্রুত অভিযান শেষ করাও সহজ।
স্থলযুদ্ধের সম্ভাবনা প্রায় নেই
প্রায় সব বিশেষজ্ঞ স্থল আক্রমণের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন। অরিনোকো রিসার্চের প্রতিষ্ঠাতা এলিয়াস ফেরর বলেন, এই মুহূর্তে হামলার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ, এই অঞ্চলে স্থল আক্রমণের জন্য মার্কিন বাহিনীর যথেষ্ট শক্তি নেই।
নেদারল্যান্ডসের লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞানী সান্তিনো রেজিলমে বলেন, ‘স্থল অভিযান আইনগত জটিলতা, কংগ্রেসের বিরোধিতা এবং ইরাক-আফগানিস্তানের অভিজ্ঞতার কারণে খুব একটা সমর্থন পাবে না।’
সান্তিনো রেজিলমে আরও বলেন, বিষয়টি ‘হামলা হবে’ নাকি ‘হবে না’, এই দ্বৈততার বদলে ‘সীমিত কিন্তু ক্রমবর্ধমান সামরিক ব্যবহারের বিস্তৃত পরিসর’ হিসেবে দেখা উচিত।
ভেনেজুয়েলার জন্য এর অর্থ কী
ওয়াশিংটনের কিছু নীতিনির্ধারক মনে করেন, হামলা হলে দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন আসতে পারে। তবে বিশ্লেষকেরা সতর্ক করছেন, এটি বরং অস্থিরতা বাড়াবে।
ফেরর বলেন, এমন হামলা ‘প্যান্ডোরার বাক্স’ খুলে দেবে। সশস্ত্র গোষ্ঠী ক্ষমতাশালী হয়ে উঠবে। সেনাবাহিনী বা রাজনৈতিক অপরাধী প্যারামিলিশিয়ারা দেশের বিভিন্ন অংশ দখলে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। তাঁর মতে, এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিরোধী দল; কারণ, তাদের কোনো সশস্ত্র শাখা নেই।
লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞানী সান্তিনো রেজিলমে বলেন, কোনো দেশে বাইরের আগ্রাসন সাধারণত ওই দেশের সরকারকে শক্তিশালী করে। এর ফলে ‘র্যালি-অ্যারাউন্ড-দ্য-ফ্ল্যাগ এফেক্ট’ তৈরি হবে। এটি জাতীয়তাবাদী সমর্থন তৈরি করবে এবং সরকার ভিন্নমত দমন করার অজুহাত পাবে।
লিবিয়া, ইরাকসহ বহু দেশের উদাহরণ দেখিয়ে সান্তিনো রেজিলমে বলেন, বহিরাগত হস্তক্ষেপ খুব কম দেশেই স্থিতিশীল গণতন্ত্র এনেছে।
মাদুরো সরকারও প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জিং ভঙ্গি নিয়েছে। নভেম্বরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিওসদাদো কাবেলো বলেন, ‘তারা (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) মনে করে, বোমা ফেলে সব শেষ করবে। এখানে? এই দেশে?’
মাদুরোও বলেন, ‘আমরা শান্তি চাই, কিন্তু দাসের মতো শান্তি নয়। সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার ভিত্তিতে শান্তি চাই।’
মার্কিন কৌশল কী
সিএসআইসির উপদেষ্টা এবং সাবেক মেরিন কর্নেল মার্ক ক্যানসিয়ান জানান, মাদুরোর প্রতি ভেনেজুয়েলার সামরিক বাহিনীর যে আনুগত্য, সেটা দুর্বল করতে কাজ করছে সিআইএ। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সামরিক বাহিনীকে বার্তা দিতে পারে, তারা যদি লড়াই না করে ব্যারাকে থাকে, তাহলে তাদের ওপর হামলা হবে না।
১৯৯১ সালের ডেজার্ট স্টর্মে (উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়) যুক্তরাষ্ট্র একই কৌশল ব্যবহার করেছিল। এখানে মার্কিন কর্মকর্তারা গোপনে কিছু ইরাকি ইউনিটকে সংকেত দিয়েছিলেন যে তারা যদি লড়াই না করে ব্যারাকে থাকে, তবে তাদের লক্ষ্যবস্তু করা হবে না। এই কৌশল প্রতিরোধের মাত্রা কমাতে সাহায্য করেছিল।
তবে ক্যানসিয়ান মনে করেন, মাদুরোর সরকার ইতিমধ্যে সেনাবাহিনী থেকে তাদের বিরোধী মতাদর্শীদের সরিয়ে ফেলেছে এবং লড়াইয়ের সম্ভাবনাই বেশি।
ভেনেজুয়েলার সেনাবাহিনী কী করতে পারে
অরিনোকো রিসার্চের প্রতিষ্ঠাতা এলিয়াস ফেরর বলেন, সবকিছু নির্ভর করবে হামলার আগে যুক্তরাষ্ট্র তাদের কী বার্তা দেয় তার ওপর।
ওয়াশিংটনের সামনে দুটি পথ রয়েছে। প্রথমত, তারা সামরিক বাহিনীকে বলবে, ‘আমরা সফল হলে তোমরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, ব্যবসা ও ক্ষমতায় থাকতে পারবে।’ দ্বিতীয়ত, ইরাকে ‘ডি-বাথিফিকেশনের’ মতো সব অফিসার-সৈন্যকে সরিয়ে দেওয়া।
ফেররের মতে, সামরিক বাহিনীকে কোণঠাসা করলে দেশজুড়ে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ দেখা দিতে পারে।
প্রসঙ্গত, ডি-বাথিফিকেশন (De-Ba’athification) হলো ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণের পর মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন প্রোভিশনাল অথরিটির (সিপিএ) একটি নীতি। এর লক্ষ্য ছিল সাদ্দাম হোসেনের বাথ পার্টির (Ba’ath Party) সব সদস্যকে সরকারি পদ, প্রশাসন ও সামরিক বাহিনী থেকে অপসারণ করে ইরাকের সমাজকে বাথবাদী প্রভাবমুক্ত করা।
সাধারণ ভেনেজুয়েলানদের প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে
বিশ্লেষকদের মতে, পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল হবে। হাইপারইনফ্লেশন বা চরম মুদ্রাস্ফীতি, দীর্ঘমেয়াদি সংকট, আর্থিক পতন, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বাস্তু সংকট তৈরি হতে পারে।
২০২৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার ৭৯ লাখ অর্থাৎ ২৮-৩০ শতাংশ মানুষের মানবিক সহায়তার প্রয়োজন।
রাজনৈতিক বিজ্ঞানী সান্তিনো রেজিলমে বলেন, এমন অবস্থায় মার্কিন হামলা জনগণের কাছে হবে ভয়াবহ নিরাপত্তাহীনতা। খাদ্য, ওষুধ, বিদ্যুৎ ও মৌলিক সেবার ওপর আরও চাপ তৈরি হবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া কেমন হবে
চীন ভেনেজুয়েলার অন্যতম বড় অর্থনৈতিক অংশীদার ও ঋণদাতা। বিশ্লেষকদের মতে, তারা মাদুরোর প্রতি কূটনৈতিক সমর্থন বজায় রাখবে, কিন্তু যুদ্ধ শুরু হলে সরাসরি ভূমিকা সীমিত থাকবে।
ভেনেজুয়েলান বিশ্লেষক কার্লোস পিনা বলেন, সশস্ত্র সংঘাত শুরু হলে চীনের প্রভাব সীমিত হবে। অন্যদিকে রাশিয়া ভেনেজুয়েলার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ, গোয়েন্দা সহায়তাসহ সামরিক সহযোগিতা বজায় রেখেছে। পিনার মতে, রাশিয়া সামরিক পরামর্শে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। তবে দুই দেশই রাজনৈতিকভাবে মাদুরোর পাশে থাকবে।
মার্কিন আক্রমণ কি অন্য দেশেও ছড়াতে পারে
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, ভেনেজুয়েলার ঘটনাকে সামনে রেখে লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশেও একই মডেল প্রয়োগ করা হতে পারে। চলতি সপ্তাহে এক বৈঠকে ট্রাম্প সতর্ক করেন, যেকোনো মাদক উৎপাদনকারী দেশই যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে তিনি কলম্বিয়ার কোকেন উৎপাদনের কথা তুলে ধরেন।
লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞানী সান্তিনো রেজিলমে বলেন, ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে মার্কিন পদক্ষেপ একক দেশের নীতি নয়; বরং জটিল রাজনৈতিক সংকটগুলোকে ‘নার্কো-টেররিস্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করে সামরিক হস্তক্ষেপ বৈধ করার এক নতুন ছক। যদি এই পদ্ধতি অন্যান্য দেশে প্রয়োগ করা হয়, তবে আন্তর্জাতিক আইন ও আঞ্চলিক শান্তি প্রক্রিয়া আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, এতে ড্রাগ ট্রাফিকিং, অভিবাসন সংকটসহ আরও অনেক সমস্যার সমাধান সামরিকীকরণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। এগুলো আর সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা থাকবে না।
(কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা)