বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলার শেয়ারহোল্ডাররা কোম্পানির প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্কের জন্য এমন একটি ঐতিহাসিক প্যাকেজ অনুমোদন করেছেন, যা করপোরেট বিশ্বের ইতিহাসে এর আগে কেউ কল্পনাও করেনি।
যদি আগামী এক দশকে মাস্ক নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেন, তবে তিনি টেসলার ১ ট্রিলিয়ন ডলার (প্রায় ৮৫ লাখ কোটি টাকার সমতুল্য) সমমূল্যের শেয়ারের অধিকারী হবেন। তবে কর ও অন্যান্য কর্তনের পর প্রকৃত মূল্য দাঁড়াবে প্রায় ৮৭৮ বিলিয়ন ডলার। আগামী দশকে মাস্কের লক্ষ্য হলো— ২ কোটি গাড়ি উৎপাদন, ১০ লাখ রোবোট্যাক্সি চালু, ১০ লাখ রোবট বিক্রি এবং ৪০০ বিলিয়ন ডলার মূল মুনাফা অর্জন। তবে এ জন্য টেসলার বাজারমূল্যও বাড়াতে হবে—বর্তমান ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার থেকে প্রথমে ২ ট্রিলিয়ন, এরপর ৮.৫ ট্রিলিয়ন ডলারে।
এই বিপুল অঙ্কের ব্যক্তিগত সম্পদ বিশ্বের বহু উন্নত অর্থনীতির বার্ষিক মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) থেকেও বেশি। এই সংখ্যাটি বাস্তবে ঠিক কী বোঝায়, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে।
১ ট্রিলিয়ন ডলারে কী কী কেনা যায়?
ইলন মাস্কের বেতনের এই সম্ভাব্য অর্থ এতই বিশাল যে, বিষয়টির বিশালতা বোঝাতে বিশ্লেষকদের বৃহৎ করপোরেট এমনকি দেশের অর্থনীতির সঙ্গে তুলনা করতে হচ্ছে। কারণ ১ ট্রিলিয়ন ডলারের মতো অঙ্ক প্রচলিত যেকোনো তুলনামূলক হিসাবে অর্থ বোঝানোর সক্ষমতাকে ছাড়িয়ে গেছে।
একটি সাধারণ সময়সীমার হিসেবে, যদি কোনো ব্যক্তি প্রতি সেকেন্ডে ৪০ ডলার খরচ করতে থাকেন, তবে এই অর্থ নিঃশেষ করতে তাঁর প্রায় ৮০০ বছর লাগবে!
সম্পদ ক্রয়ের ভিত্তিতে ১ ট্রিলিয়ন ডলারে যা কেনা সম্ভব:
যুক্তরাষ্ট্রের বিলাসবহুল হাওয়াই অঙ্গরাজ্যের সমস্ত বাড়ি: প্রায় ৫ লাখ ৭২ হাজার বাড়ির গড় মূল্য ৮ লাখ ২৬ হাজার ডলার ধরলে, পুরো রাজ্যের আবাসন খাত এই অর্থের মধ্যে স্বচ্ছন্দেই কেনা সম্ভব।
একাধিক বৈশ্বিক করপোরেশন: পুরো আইভি লিগ-এর তহবিল পাঁচবারের বেশি কেনা যেতে পারে। কোকাকোলা অধিগ্রহণ করার পরও এই অর্থ থেকে শত শত বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত থাকবে যা দিয়ে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্য এক বারো-প্যাক কোক কেনা সম্ভব।
বিশ্বের বৃহৎ সব অটোমোবাইল প্রস্তুতকারক সংস্থা: টয়োটা, ফক্সওয়াগন, স্টেলান্টিস, হুন্দাই, ফোর্ড এবং জেনারেল মোটরস এক সঙ্গে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের একক কোম্পানির অধীনে আনা যেতে পারে।
শিল্প-স্তরের অবকাঠামো: এক ট্রিলিয়ন ডলার দিয়ে ৩০০টিরও বেশি অতি-উচ্চ আকাশচুম্বী অট্টালিকা নির্মাণ করা যেতে পারে, যার প্রতিটির নির্মাণ ব্যয় প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার। অথবা বিশ্বের বৃহত্তম ক্রুজ জাহাজ ‘আইকন অব দ্য সিস’ আকারের ৪৬০টিরও বেশি জাহাজ কেনা যেতে পারে।
একটি ব্যক্তিগত নৌবাহিনী-আকারের বহর: বেশ কয়েকশ গভীর সমুদ্রের জাহাজ মোতায়েন করা যেতে পারে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় নৌবহরের আকারের সমান।
অতি-বিলাসবহুল সম্পদ: জেফ বেজোসের ৫০০ মিলিয়ন ডলারের মেগা-ইয়টটি ২ হাজার বার তৈরি করা যেতে পারে, এমনকি প্রতিটি জাহাজের বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ খরচ যা কোটি কোটি ডলারে পৌঁছে, তা সহই।
জ্বালানি শিল্পে বৃহৎ সংস্থা: এক্সনমোবিল, শেভরন এবং কনোকোফিলিপস, অর্থাৎ তিনটি বৃহত্তম পাবলিকলি ট্রেডেড মার্কিন তেল কোম্পানি, সবকটিই সরাসরি কেনা যাবে।
দেশব্যাপী নগদ অর্থ বিতরণ: এক ট্রিলিয়ন ডলার দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিককে প্রায় ৩ হাজার ডলার নগদ অর্থ দেওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের জিডিপির সঙ্গে তুলনা
ইলন মাস্কের বর্তমান মোট সম্পদ ইতিমধ্যে ডেনমার্ক, মালয়েশিয়া এবং বাংলাদেশের মতো বেশ কয়েকটি দেশের বার্ষিক জিডিপিকে ছাড়িয়ে গেছে।
যদি মাস্ক সম্পূর্ণ বেতন প্যাকেজটি অর্জন করেন, তবে তাঁর ব্যক্তিগত আর্থিক অবস্থান এমন এক ক্যাটাগরিতে প্রবেশ করবে, যেখানে কেবল বৃহৎ অর্থনীতিকেই রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করা যায়। সে ক্ষেত্রে তাঁর সম্ভাব্য সম্পদ সুইজারল্যান্ডের বার্ষিক জিডিপির থেকেও বড় হবে এবং তেলসমৃদ্ধ সৌদি আরবের জিডিপির চেয়ে সামান্য কম হবে।
টেসলার শেয়ারহোল্ডারদের এই ভোটের ফলে ইলন মাস্ক আর কেবল একজন করপোরেট নেতা নন। তিনি ইকুইটি এবং বাজার মূল্যের ভিত্তিতে তাঁর আর্থিক অবস্থান এখন এমন এক ‘রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের’ মতো ক্ষমতার ইঙ্গিত দেয়, যিনি কেবল তাঁর আর্থিক সক্ষমতা ও বিশালতার জোরেই বিশ্ববাজারকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। টেসলা যদি এই লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জন করতে পারে, তবে তাঁর সেই প্রভাব আরও বাড়বে।