মঙ্গল গ্রহের অভ্যন্তরে বিশাল আকৃতির রহস্যময় কিছু গঠন খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এগুলো প্রাচীন ‘প্রোটোপ্ল্যানেট’ বা ‘অপূর্ণাঙ্গ গ্রহের’ অংশ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, এসব ঘন বস্তু মঙ্গলের অভ্যন্তরে কোটি কোটি বছর ধরে অবিকৃত অবস্থায় টিকে আছে।
প্রোটোপ্ল্যানেট হলো এমন এক মহাজাগতিক বস্তু, যা কোটি কোটি বছর আগে গ্রহে পরিণত হওয়ার পথে ছিল। সৌরজগতের শুরুর দিকে ধুলো ও পাথরের কণা একত্রিত হয়ে এ ধরনের বস্তু তৈরি হয়। যথেষ্ট উপাদান জোগাড়ের মাধ্যমে একসময় বড় হয়ে পূর্ণাঙ্গ গ্রহে পরিণত হতে পারত। তবে কখনো কখনো এগুলো ধ্বংস হয়, কখনো অন্য গ্রহের অংশ হয়ে যায়।
নতুন গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে ২৮ আগস্ট, আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্সে। গবেষক দলটি নাসার ইনসাইট (InSight) ল্যান্ডারের সংগৃহীত তথ্যে বিশ্লেষণ চালান। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ইনসাইট মঙ্গলের ভূপৃষ্ঠের কম্পন বা ‘মার্সকোয়েক’ পর্যবেক্ষণ করেছিল। এরপর সৌর প্যানেলে ধুলা জমে যাওয়ায় এর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
মার্সকোয়েকগুলোর কম্পন কোনোভাবে মঙ্গলের অভ্যন্তর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন কয়েক ডজন অজানা গঠন, যেগুলো আশপাশের শিলার তুলনায় অনেক বেশি ঘন। এসব গঠন গভীর ম্যান্টলের (মঙ্গলের পৃষ্ঠ ও কেন্দ্রের মাঝের অংশ) মধ্যে অবস্থিত, যার গড় গভীরতা প্রায় ৯৬০ মাইল (প্রায় ১ হাজার ৫৫০ কিলোমিটার)। এই অঞ্চলের তাপমাত্রা পৌঁছাতে পারে ২ হাজার ৭০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট (১ হাজার ৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) পর্যন্ত।
ইম্পিরিয়াল কলেজ লন্ডনের গ্রহবিজ্ঞানী এবং গবেষণার প্রধান লেখক কনস্টানটিনোস চারালাম্বুস বলেন, ‘আমরা আগে কখনো কোনো গ্রহের অভ্যন্তরকে এত সূক্ষ্মভাবে দেখতে পারিনি। আমরা দেখছি, ম্যান্টলের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে প্রাচীন ভগ্নাংশ।’
গবেষকদের মতে, এসব ‘ব্লব’ (গোলাকার বস্তু) সৃষ্টি হয়েছিল প্রায় ৪৫০ কোটি বছর আগে, যখন বিশাল আকারের বস্তু বা প্রোটোপ্ল্যানেট মঙ্গলের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। যদি এই প্রোটোপ্ল্যানেটগুলো তাদের পথচলায় বাধা না পেত, তবে পূর্ণাঙ্গ গ্রহে পরিণত হতে পারত।
তারা আরও বলেন, ইনসাইট থেকে প্রাপ্ত কম্পনের কিছু সংকেত অন্যদের তুলনায় ধীরগতিতে প্রবাহিত হয়েছিল। এই পার্থক্য বিশ্লেষণ করে তাঁরা বুঝতে পারেন, নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে পাথর অনেক বেশি ঘন এবং ভিন্ন প্রকৃতির, যা ইঙ্গিত দেয়—সেগুলোর উৎপত্তি স্থানীয় নয়।
মঙ্গল একটি একক প্লেটবিশিষ্ট গ্রহ, যার ভূত্বক পৃথিবীর মতো বিভিন্ন টেকটোনিক প্লেটে বিভক্ত নয়। পৃথিবীতে ভূত্বক একে অপরের নিচে চলে গিয়ে ম্যান্টলে মিশে যায় এবং সেখানে গলিত পাথরের প্রবাহ সৃষ্টি হয়। তবে মঙ্গলে এমন কিছু হয় না। ফলে গ্রহটির অভ্যন্তর অনেকটা ‘স্থির’ এবং সক্রিয়তা কম।
এই গঠনগুলো মঙ্গলের অভ্যন্তরের স্থবিরতার আরেকটি প্রমাণ। চারালাম্বুস বলেন, ‘এসব গঠন আজও টিকে আছে, এর মানে হচ্ছে মঙ্গলের ম্যান্টল কয়েক বিলিয়ন বছর ধরে খুব ধীরগতিতে বিবর্তিত হয়েছে। যদি এটি পৃথিবী হতো, তবে সম্ভবত এমন চিহ্নগুলো মুছে যেত অনেক আগেই।’
মঙ্গলে প্লেট টেকটনিক না থাকায় সেখানে ভূকম্পন হয় ভূমিধস, বড় আকারের পাথর ভেঙে গিয়ে বা উল্কাপিণ্ডের পতনের ফলে। এর আগেও ইনসাইটের ডেটা বিশ্লেষণ করে মঙ্গলের গভীরে বিশাল আকারের একটি ভূগর্ভস্থ সমুদ্রের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল।
চার বছরব্যাপী মিশনে ইনসাইট মোট ১ হাজার ৩১৯টি মার্সকোয়েকের তথ্য সংগ্রহ করে। এত বিশদভাবে মঙ্গলের অভ্যন্তরকে চিহ্নিত করা যাবে, তা গবেষকেরা প্রত্যাশাও করেননি।
ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের আরেক গবেষক এবং সহলেখক টম পাইক বলেন, ‘আমরা জানতাম মঙ্গল তার গঠনের শুরুর দিককার ইতিহাস ধারণ করে রেখেছে, তবে ইনসাইটের মাধ্যমে আমরা যে স্পষ্টতা পেয়েছি, তা কল্পনাও করিনি।’
তথ্যসূত্র: লাইভ সায়েন্স