দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল হলো। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাতিল করা এ ব্যবস্থা পুনর্বহাল করে গতকাল বৃহস্পতিবার রায় দিয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। তবে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এ ব্যবস্থা কার্যকর হবে আগামী চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের রায়কে ত্রুটিপূর্ণ ও কলঙ্কিত উল্লেখ করে তা সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়েছে গতকালের রায়ে। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বিভাগ এ বি এম খায়রুল হকের বেঞ্চের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল মঞ্জুর এবং এ-সংক্রান্ত রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তি করে এ রায় দেন।
সংবিধানের চতুর্থ ভাগের পরিচ্ছেদ ২ক-এর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারসম্পর্কিত বিধানাবলী, যা সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯৬ (১৯৯৬ সালের ১ নং আইন) এর ধারা ৩ দ্বারা সন্নিবেশিত হয়েছিল, তা এই রায়ের মাধ্যমে পুনরুজ্জীবিত করা হলো। রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, এরূপ পুনরুজ্জীবন পরিচ্ছেদ ২ ক-এ বর্ণিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত বিধানাবলীর স্বয়ংক্রিয় পুনঃস্থাপন নিশ্চিত করে। তবে পুনরুজ্জীবিত অনুচ্ছেদ ৫৮ খ(১) এবং অনুচ্ছেদ ৫৮ গ(২)-এর বিধানাবলীর প্রয়োগ সাপেক্ষে তা কার্যকর হবে। পুনঃস্থাপিত ও পুনরুজ্জীবিত পরিচ্ছেদ ২ ক-এ বর্ণিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত বিধানাবলী ভবিষ্যতে প্রয়োগযোগ্যতার ভিত্তিতেই কার্যকর হবে। অর্থাৎ আগামী ত্রয়োদশ নির্বাচনের পর গঠিত জাতীয় সংসদ ভেঙে যাওয়ার পর থেকে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে।
রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ আগামী দিনে নিজের ভোট নিজে দিতে পারবেন। দিনের ভোট রাতে হবে না। মৃত মানুষ এসে ভোট দিয়ে যাবেন না। বাংলাদেশ এ রকম একটি গণতান্ত্রিক মহাসড়কে চলা শুরু করল বলে আমরা মনে করি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলোপ করে যে নির্বাচন হয়েছিল, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের যে কবর রচিত হয়েছিল, আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল হওয়ার পর গণতান্ত্রিক মহাসড়কে বাংলাদেশ হাঁটবে।’
পঞ্চদশ সংশোধনী মামলার সঙ্গে এই রায় কোনোভাবে সাংঘর্ষিক হবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছিল। এটা পঞ্চদশ সংশোধনীর ইস্যু। অসৎ উদ্দেশ্যে এ সংশোধনী আনা হয়েছিল। হাইকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে যে রায় দিয়েছেন, সেই অংশ আপিল বিভাগে চ্যালেঞ্জ হয়নি। যদি চ্যালেঞ্জ হয়ও, আপিল বিভাগের এই রায়কে অতিক্রম করবে না। এটি রিভিউয়ের রায়। রিভিউয়ে আপিলের অনুমতি দিয়ে এই রায় হয়েছে।
রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করা পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির অন্যতম সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘দীর্ঘ সংগ্রামের পর শেষপর্যন্ত আমরা একটা ফলাফল পেয়েছি, আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যার ফলে তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন হয়েছে, অগণতান্ত্রিক নির্বাচন হয়েছে। আশা করি, ভবিষ্যতে এর মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ সুগম হবে।’
সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী গৃহীত হয়। ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৮ সালে হাইকোর্টে রিট করা হয়। ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট হাইকোর্ট ওই রিট খারিজ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বৈধ ঘোষণা করেন। এর বিরুদ্ধে রিট আবেদনকারী পক্ষ ২০০৫ সালে আপিল করেন। ২০১১ সালের ১০ মে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন। সংক্ষিপ্ত রায় দেওয়ার প্রায় ১৬ মাস পর ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। তবে সংক্ষিপ্ত রায়ের পরই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি আপিল বিভাগের ওই রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে ২৭ আগস্ট আবেদন করেন। পরে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারও রিভিউ আবেদন করেন। এ ছাড়া নওগাঁর রাণীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনও আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করেন।
রিভিউ আবেদনের শুনানি শেষে চলতি বছরের ২৭ আগস্ট লিভ (আপিলের অনুমতি) মঞ্জুর করে আদেশ দেন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। আপিলের শুনানি শেষে ১১ নভেম্বর আপিল বিভাগ রায় ঘোষণার জন্য ২০ নভেম্বর দিন ধার্য করেন।
রায়ের পর জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে থাকা আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘৪১ বছর আগে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। আমরা তখনই বলেছিলাম গণতন্ত্র, নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা—এগুলোকে একটা থেকে আরেকটাকে আলাদা করা যাবে না। একটা পিলার ছাড়া যে রকম ঘর দাঁড়িয়ে থাকে না, তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলো এরকম একটা পিলার। এটিকে সরিয়ে ফেললে অবাধ নির্বাচন সম্ভব নয়। অবাধ নির্বাচন না হলে গণতন্ত্রও সম্ভব নয়।’
পঞ্চদশ সংশোধনীর বিষয়ে শিশির মনির বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনী হাইকোর্ট আংশিক বাতিল ঘোষণা করেছেন। এর বিরুদ্ধে আপিল হয়েছে। এটির জন্য অপেক্ষা করা দরকার বলে তিনি মনে করেন। তা না হলে একটি জিনিস পরিপূর্ণভাবে সেটেল হবে না। একটা বিতর্ক থেকেই যাবে। তিনি আশা করেন, ওই আপিল দ্রুত নিষ্পত্তি হবে। পঞ্চদশ সংশোধনী মামলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বাইরেও প্রায় ২৯টি ইস্যু রয়েছে। যার চারটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। বাকিগুলোর বিষয় হাইকোর্ট সংসদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। এর বিরুদ্ধে তাঁরা আপিল করেছেন, সব বিবেচনা করা হবে।
ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ আর ভোটাধিকারের সুযোগ পায়নি। সংবিধানের মৌলিক কাঠামো গণতন্ত্র, মৌলিক কাঠামো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, জনগণের ভোটাধিকার। এই মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করা যায় না। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের রায়টি তাঁর ব্যক্তিগত ইচ্ছা এবং ব্যক্তিগত মতামতের প্রতিফলন ছাড়া কোনো রায় কিংবা নজির হিসেবে তাঁরা গ্রহণ করেননি। এ কারণে তাঁরা রিভিউ আবেদন করেছিলেন।