প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে একাধিক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেছেন।
তিনি অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী, নেদারল্যান্ডসের রানি ম্যাক্সিমা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক, চিলির সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং উরুগুয়ের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনে যোগদানের পর প্রধান উপদেষ্টা অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। তাঁদের সংক্ষিপ্ত কথোপকথনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংস্কারমূলক কার্যক্রম, আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন এবং অস্ট্রেলিয়ায় বেড়ে ওঠা বাংলাদেশি অভিবাসীদের নিয়ে আলোচনা হয়।
অধ্যাপক ইউনূস আগামী ফেব্রুয়ারির শুরুতে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তাঁর সরকারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। তিনি নির্বাচন প্রক্রিয়ার সততা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের উপস্থিত থাকার আশা প্রকাশ করেন।
প্রধানমন্ত্রী আলবানিজ অস্ট্রেলিয়ায়, বিশেষ করে তাঁর নিজের নির্বাচনী এলাকায় বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের ক্রমবর্ধমান অবদানের প্রশংসা করেন। তিনি কয়েক বছর আগে ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ দিবস স্মরণে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার স্মৃতিচারণাও করেন।
পরে অধ্যাপক ইউনূস নেদারল্যান্ডসের রানি ম্যাক্সিমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রানি একই সঙ্গে জাতিসংঘের মহাসচিবের সর্বজনীন আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য বিশেষ অ্যাডভোকেট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁদের আলোচনায় বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথে স্বাস্থ্যবিমার সুযোগ সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
তাঁরা জীবন ও স্বাস্থ্য বিমা, দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় এবং পেনশন স্কিমসহ আর্থিক খাতে বিভিন্ন উদ্ভাবন নিয়ে আলোচনা করেন এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তির গুরুত্ব তুলে ধরেন। অধ্যাপক ইউনূস গর্ভকালীন সময়ে মাতৃস্বাস্থ্য পরিচর্যার জন্য ঋণের জরুরি প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তিনি গ্রামীণ নারীদের শীর্ষস্থানীয় চিকিৎসকদের সঙ্গে যুক্ত করতে ডিজিটাল স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রস্তাব দেন, যা অসংখ্য জীবন বাঁচাতে পারে।
বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস সামাজিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ওষুধ উৎপাদনকারীদের পরিচালনার আহ্বান জানিয়ে বৈশ্বিক ওষুধশিল্প পুনর্গঠনেরও আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘সামাজিক ব্যবসার আওতায় ওষুধ কোম্পানিগুলো ভ্যাকসিন তৈরি করলে তা সাশ্রয়ী হবে।’
প্রধান উপদেষ্টা রানি ম্যাক্সিমকে সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। বৈঠকে রয়্যাল হাইনেস প্রিন্সেস অব অরেঞ্জ, ক্যাথারিনা-অমালিয়াও উপস্থিত ছিলেন।
এ ছাড়া অধ্যাপক ইউনূস বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক ড. তেদ্রোস আধানম গেব্রেইয়েসুসের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। তাঁদের আলোচনায় পারস্পরিক অগ্রাধিকারের বিভিন্ন বিষয় এবং সাম্প্রতিক বৈশ্বিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন নিয়ে কথা হয়।
দিনের শেষের দিকে প্রধান উপদেষ্টা দুটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে অংশ নেন: একটি ছিল ‘উন্নয়নের জন্য ফ্যাশন’বিষয়ক, অন্যটি ছিল সামাজিক উদ্ভাবনে সরকারি ও বেসরকারি খাতের সহযোগিতাবিষয়ক।
নিউইয়র্কে ‘দেয়ারওয়ার্ল্ড’-এর বার্ষিক গ্লোবাল এডুকেশন ডিনারে সম্মানিত অধ্যাপক ইউনূস
নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সময় অনুষ্ঠিত ‘দেয়ারওয়ার্ল্ড’-এর বার্ষিক উচ্চপর্যায়ের গ্লোবাল এডুকেশন ডিনারে বিশ্বব্যাপী নেতাদের এবং পরিবর্তনকারীদের একত্রিত করে সবার জন্য শিক্ষার পক্ষে সমর্থন জানায়। নিউইয়র্কের একটি হোটেলে এই আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানের একটি কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী (২০০৬) এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাঁর অগ্রণী কাজ এবং শিক্ষার প্রতি তার অটল প্রতিশ্রুতির স্বীকৃতিস্বরূপ ‘দেয়ারওয়ার্ল্ড’-এর ‘আনলক বিগ চেঞ্জ’ পুরস্কার প্রদান।
‘দেয়ারওয়ার্ল্ড’ একটি বৈশ্বিক শিশু দাতব্য সংস্থা, যা বৈশ্বিক শিক্ষাসংকট দূর করতে এবং পরবর্তী প্রজন্মের সম্ভাবনা উন্মোচন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
অনুষ্ঠানটির সহ-আয়োজক ছিলেন গর্ডন ব্রাউন, যিনি জাতিসংঘের গ্লোবাল এডুকেশনের বিশেষ দূত এবং যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ‘দেয়ারওয়ার্ল্ড’ এর চেয়ার ও গ্লোবাল বিজনেস কোয়ালিশন ফর এডুকেশনের এক্সিকিউটিভ চেয়ার সারাহ ব্রাউন। এই আয়োজনে জীবন ও সমাজ পরিবর্তনে শিক্ষার ক্ষমতাকে উদ্যাপন করা হয়।
পুরস্কার প্রদানের সময় গর্ডন ব্রাউন ইউনূসকে একজন বৈশ্বিক অগ্রদূত হিসেবে প্রশংসা করেন, যার কাজ লাখ লাখ মানুষকে ক্ষমতায়ন করেছে। তিনি বলেন, ‘গত ৫০ বছরে বেসরকারি খাতে এমন কোনো প্রকল্প নেই, যা মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে এতটা কাজ করেছে।’
মঙ্গলবার ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের উদ্যোগে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ফাঁকে ‘নিউইয়র্কে সামাজিক উদ্ভাবন: সামাজিক উদ্ভাবনের মাধ্যমে অর্থায়ন সংগ্রহ’ শীর্ষক সরকারি ও বেসরকারি খাতের নেতাদের এক সভায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস যোগ দেন।
এ ছাড়া একই দিন নিউইয়র্কে প্যারিসের মেয়র অ্যান হিদালগো প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।