কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের অনলাইনে ঘোষিত ‘লকডাউন’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাজধানীজুড়ে ছিল কঠোর নিরাপত্তা বলয়। গত দুই দিনে ১০-১২টি গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঘটনার পর গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীতে সে ধরনের নাশকতার ঘটনা ঘটেনি। তবে ঢাকার বাইরে রেললাইনে নাশকতার চেষ্টা, বাস-ট্রাক পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন দলটির নেতা-কর্মীরা।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই ঢাকার রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা ছিল অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেক কম। শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়, সড়ক ও প্রবেশপথে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, এপিবিএন ও সেনাসদস্যদের টহল জোরদার করা হয়। সন্দেহভাজন ব্যক্তি ও যানবাহনে তল্লাশি চালানো হয় সর্বত্র। গত ২৪ ঘণ্টায় অভিযান চালিয়ে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের ৬০ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে পুলিশ।
এর আগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণা নিয়ে অনলাইনে কর্মসূচি ঘোষণা করে দলটি। এরপর গত মঙ্গল ও বুধবার ২০টির বেশি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় দুর্বৃত্তরা। তবে গতকাল এমন ঘটনা কম ঘটেছে। গতকাল সকালে মিরপুরে পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট-সংলগ্ন (পিওএম) কাফরুল থানার সামনে দুটি ককটেল নিক্ষেপের চেষ্টা করেন এক যুবক। স্থানীয় জনতা ও পুলিশ সদস্যদের তৎপরতায় তাঁকে ঘটনাস্থল থেকে আটক করা হয়। এ ছাড়া ধানমন্ডি ৩২ ও শাহবাগ থেকে সন্দেহভাজন নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের দুই সদস্যকে আটক করা হয়।
এদিকে গতকাল বেলা ১টার দিকে গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। সেখানে ভবনের কয়েকটি ম্যুরাল ভাঙচুর এবং চতুর্থ তলার ফাঁকা স্থানে কাঠ, কাগজ ও ব্যানার জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ সময় ভবনের ভেতর থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়।
গতকাল সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, সুপ্রিম কোর্ট এলাকা, কাকরাইল, পল্টনসহ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রবেশপথে অবস্থান নেয় পুলিশের সাঁজোয়া যান; প্রবেশের সময় আইনজীবী ও সাংবাদিকদেরও তল্লাশি করা হয়। ঢাকার প্রবেশমুখগুলোতেও একইভাবে কড়া তল্লাশি চলে। রাজধানীর গাবতলী, মহাখালী, যাত্রাবাড়ী, সাইনবোর্ড, আবদুল্লাহপুর, শনির আখড়া, মাতুয়াইল, দোলাইরপাড় ও পোস্তগোলা ফ্লাইওভার এলাকায় বিশেষ চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এদিকে রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফের পরপর তিনটি ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। তবে এ ঘটনায় কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। বিমানবন্দর গোলচত্বরসংলগ্ন প্রবেশ গেট ও সেন্টার পয়েন্ট ইউনিমার্ট মার্কেটের সামনে গতকাল রাত সোয়া ১০টার দিকে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো ঘটে। এর আগে গোলচত্বরসংলগ্ন বিমানবন্দরে প্রবেশ পথের মূল গেটে গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
গতকালের ঘটনা প্রসঙ্গে প্রত্যক্ষদর্শী একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিমানবন্দরের বিআরটি উড়াল সড়কের ওপর দিয়ে উত্তরার দিকে একটি ট্রাক যাচ্ছিল। যাওয়ার পথে ট্রাক থেকে তিনটি ককটেল বিমানবন্দরের গেট লক্ষ্য করে ছোড়া হয়। এর পরপরই ট্রাকটি চলে যায়।
ককটেল বিস্ফোরণের সময় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের গেটে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছিলেন এপিসি চন্দ্র শেখর মণ্ডল। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘হঠাৎ উড়াল সড়কের ওপর থেকে তিনটি ককটেল মেরে কে বা কারা পালিয়ে গেছে।’
এ বিষয়ে ডিএমপির বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তাসলিমা আক্তার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য পটকা ফোটানো হয়েছে।’
ট্রেনে নাশকতার চেষ্টা
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার বাসুদেব ইউনিয়নের দুবলা এলাকায় বুধবার দিবাগত রাত পৌনে ২টার দিকে রেললাইনে আগুন দেওয়া হয়। এতে চট্টগ্রামগামী তূর্ণা নিশীথা পাঘাচং রেলস্টেশনে এবং একই পথের বিজয় এক্সপ্রেস ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনে আটকা পড়ে। তবে আধা ঘণ্টার ব্যবধানে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
বগুড়ার সুখানপুকুর এলাকায় গতকাল ভোরে রেললাইনের ফিশপ্লেট খুলে নাশকতার চেষ্টা চালায় দুর্বৃত্তরা। পরে রেলের কর্মীরা ফিশপ্লেটগুলো পুনরায় স্থাপন করে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখেন।
পেট্রলবোমা হামলা
গোপালগঞ্জে গতকাল ভোরে গণপূর্ত অফিসে বেশ কয়েকটি পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় একটি গাড়িতে আগুন ধরে যায়। খুলনা সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক সেরেস্তায় বুধবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে পেট্রলবোমা হামলা করেছে দুর্বৃত্তরা। ঘটনার পরপরই টুটপাড়া ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট এক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
বাস-ট্রাকে আগুন
শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবা এলাকায় গতকাল সকালে একটি চিনির ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া এক্সপ্রেসওয়ের নাওডোবা এলাকায় মিছিল করেন কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এতে আধা ঘণ্টার বেশি সময় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের আনারপুরা এলাকায় গতকাল ভোরে থেমে থাকা একটি পণ্যবাহী ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে ট্রাকে থাকা জিনিসপত্র পুড়ে যায়।
টাঙ্গাইলের বাসাইলে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের বাঐখোলা এলাকায় বুধবার রাত ১২টার দিকে চলন্ত বাসে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। যশোর নতুন উপশহর পার্কসংলগ্ন এলাকায় গতকাল ভোরে পার্কিং করে রাখা একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। এ ছাড়া গতকাল সদর উপজেলার সুলতানপুর বাবুপাড়া গ্রাম থেকে পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহপ্রচার সম্পাদক তিতাস উদ্দিন।
সড়ক অবরোধ
ফরিদপুরে ভাঙ্গা উপজেলার আলগী ইউনিয়নের শুয়াদী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে গতকাল সকালে দেশীয় অস্ত্র হাতে মহাসড়ক অবরোধ করেন কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। এ সময় মহাসড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে এবং টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন তাঁরা। সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত এই কর্মসূচি চলে। জেলা যুবলীগ নেতা দেবাশীষ নয়ন তাঁর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে এই কর্মসূচি লাইভ করেন। এতে দেখায়, শতাধিক স্থানীয় নেতা-কর্মী দেশীয় অস্ত্র রামদা, ঢাল-সড়কি হাতে মহাসড়কে অবস্থান করছেন। এ বিষয়ে জানতে সকাল সোয়া ৯টার দিকে ভাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আশরাফ হোসেনের মোবাইলে একাধিকবার কল দিলে তিনি কেটে দেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মোবাইলে কল দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।
মাদারীপুর জেলার শিবচরে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের সূর্যনগরসংলগ্ন স্থানে গতকাল ভোরে গাছ ফেলে মহাসড়ক অবরোধের চেষ্টা করেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। তবে খবর পেয়ে শিবচর উপজেলা বিএনপির নেতা-কর্মীরা ঘটনাস্থলে এসে গাছ সরিয়ে সড়কে যান চলাচল স্বাভাবিক করেন।
অন্যদিকে গতকাল রাতে মাদারীপুর-বরিশাল মহাসড়কের মোস্তফাপুর এলাকায় টায়ার জ্বালিয়ে মহাসড়ক অবরোধের চেষ্টা করা হয়। খাগড়াছড়ির আলুটিলা এলাকায় বুধবার দিবাগত রাতে গাছ কেটে সড়ক বন্ধের চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা। চট্টগ্রামের মইজ্জ্যারটেক, ধলই ও জলিল গেট এলাকায় এবং চট্টগ্রাম-বাঁশখালী সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।
নোয়াখালী জেলা শহর মাইজদী টাউন হল মোড়ে বুধবার রাতে সড়কে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের কয়েক নেতা-কর্মী। এরপর রাত থেকে সকাল পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে আওয়ামী লীগের ৪ নেতাসহ ১২ জনকে আটক করে পুলিশ।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা]