রেলের জমি লিজ বাবদ প্রায় ৭৭ কোটি টাকা দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া রয়ে গেছে। একাধিক নোটিশ ও সতর্কবার্তা পাঠানো সত্ত্বেও অধিকাংশ লিজগ্রহীতা বকেয়া অর্থ পরিশোধে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। এতে রেলের রাজস্ব বাড়াতে নেওয়া ভূমি লিজ ব্যবস্থা প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রেলের জমির লিজ বাবদ ৭৩ কোটি ৮৫ লাখ ৮৮ হাজার ৫০০ টাকা আদায় হয়েছে। তবে বকেয়া রয়ে গেছে আরও ৭৭ কোটি ৬৬ লাখ ৬৯ হাজার ১০৭ টাকা। অন্যদিকে ভূমি উন্নয়ন কর বাবদ ৩৮ কোটি ৭২ লাখ ৪৪ হাজার ৩৮০ টাকা এবং পৌরকর বাবদ রেলের বড় অঙ্কের দেনা রয়েছে।
রেলের ভূমি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সভায় এ বিষয়টি তুলে ধরা হয়। সভার কার্যবিবরণী সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
রেল মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের মোট জমির পরিমাণ ৬০ হাজার ২১ একর। এর মধ্যে বৈধভাবে ইজারা দেওয়া হয়েছে ১৪,৪১১ একর। রেল পরিচালনার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে ৩০ হাজার ২৮৬ একর, অবৈধ দখলে আছে ৬ হাজার ৭৫৪ এবং অব্যবহৃত রয়েছে ৮ হাজার ৫৫৪ একর জমি।
বেহাত ও অবৈধ দখলে থাকা জমি উদ্ধারে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে সভায় জানানো হয়। বলা হয়, সার্টিফিকেট মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য চট্টগ্রাম, খুলনা, নীলফামারী ও বগুড়ার জেলা প্রশাসকদের কাছে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়া হয়েছে।
সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, বিপুল পরিমাণ লিজ ও লাইসেন্স ফি বকেয়া পড়ে থাকার বিষয়টি প্রমাণ করে, ভূসম্পত্তি বিভাগের তদারকি দুর্বল।
বর্তমানে রেলের ভূমি বিভাগে গড়ে মাত্র ৩৫-৪০ শতাংশ জনবল নিয়ে কাজ চলছে। জনবল সংকটের কারণে ভূমি ব্যবস্থাপনায় কাঙ্ক্ষিত মান অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। ভূমি উন্নয়ন কর দাবির সময় জেলা প্রশাসকদের পাঠানো চিঠিতে মৌজা, খতিয়ান, দাগ নম্বর ও জমির শ্রেণি উল্লেখ না থাকায় কর নির্ধারণে জটিলতা দেখা দিচ্ছে। এ ছাড়া একই কর্মস্থলে দীর্ঘদিন ধরে একই কর্মকর্তার অবস্থান ও নানা অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে।
সভায় রেলের ভূমি থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের জন্য নিয়মিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত হয়। প্রতি মাসে এ বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন রেল মন্ত্রণালয় ও রেলওয়ের প্রধান কার্যালয়ে পাঠাতে হবে। দখলমুক্ত করা জমি প্রকৌশল বিভাগের সহায়তায় দখলে রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে।
সভায় রেলের ভূমির বকেয়া থাকা লিজ ও লাইসেন্স ফি দ্রুত আদায়ের উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। উপযোগী হলেও যেসব জমি এখনো লিজ দেওয়া হয়নি, তা নিয়ম অনুযায়ী দ্রুত লিজ দিতে হবে। সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়ের গত ৮ জুলাইয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী লিজ ও লাইসেন্স ফি আদায় নিশ্চিত করতে হবে।
রেলওয়ের হিসাব বিভাগ থেকে নিয়মিত তদারকি করতে হবে এবং কোনো অসংগতি ধরা পড়লে মন্ত্রণালয়কে জানাতে হবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের ভূসম্পত্তি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০২০ হালনাগাদ করার কাজ চলছে। এ জন্য অনেক সভা হয়েছে, যেখানে ইজারা বাড়ানো ও আয় বৃদ্ধির তাগিদ দেওয়া হয়েছে। তবে দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও সংশোধিত নীতিমালা এখনো অনুমোদিত হয়নি।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, রেলের জমি লিজের বকেয়া আদায় করতে না পারা রেলওয়ের দীর্ঘদিনের দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থারই ফল। লিজের অর্থ নিয়মমতো আদায়ে নেই কার্যকর তদারকি। আবার বিপুল জমি বেদখলে। এসব কারণে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, রেলের উন্নয়ন হচ্ছে বাধাগ্রস্ত। রেলের জমি ব্যবস্থাপনা এখনো পুরোনো কাগজনির্ভর ও বিশৃঙ্খল। জমির সঠিক নথি, হালনাগাদ তথ্য ও ব্যবহার পর্যবেক্ষণের জন্য আধুনিক ডিজিটাল ডেটাবেইস গড়া জরুরি। বেদখল জমি উদ্ধার ও স্বচ্ছ লিজ ব্যবস্থাপনা চালু করতে পারলে রেলওয়ে রাজস্ব দিয়ে আত্মনির্ভর হতে পারবে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম বলেন, ‘বৈধভাবে লিজ দেওয়া জমির টাকা তোলার ব্যবস্থা নিচ্ছি। লিজের বকেয়া কিছু উঠেছে, কিছু ওঠেনি। আইনি ব্যবস্থা হিসেবে বকেয়া শোধ না করলে একপর্যায়ে উচ্ছেদ করা হয়। আর ভূসম্পত্তি ব্যবস্থাপনা নীতিমালার খসড়া রেল মন্ত্রণালয় থেকে চূড়ান্ত করে ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।’