একটি প্রাচীনতম বটবৃক্ষ মানে কালের সাক্ষী। পুরোনো কোনো স্থাপনা দেখলে যেমন মানুষ নস্টালজিয়ায় ভোগেন, তার চেয়ে বেশি মানুষ স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন, যদি কোনো শতবর্ষী গাছের ছায়ায় যান।
স্থান সাইট্টা গ্রাম, ধামরাই, ঢাকা। ব্যক্তিগত গাড়িতে সবাই যে যার মতো করে ছুটছি। শুক্রবার। তারপরেও যানজটের মহামারি ছাড়িয়ে সকাল ৯টার বদলে বেলা প্রায় ১১টায় পৌঁছাই সাভার বাজারে। তারপর নবীনগর। এরপর একটানে ঢুলিভিটা হয়ে ধানতারা। মাঝখানে নামাজের বিরতি। ধানতারা থেকে বাঁয়ে মোড় নিয়ে গাড়ি ছুটল সাইট্টার পথে।
এ এক প্রশান্তির পথ। সেই চিরচেনা সুনসান নিরিবিলি গাঁয়ের পথ। সবুজ প্রান্তর, গাছের ছায়া, পাখির কলতান। দূর থেকে গাড়ির জানালা দিয়ে যখন বটগাছ চোখে পড়ে, তখন কিছুটা নিরাশ হয়ে পড়ি। কেউ একজন মন্তব্যই করে ফেলল, এ তো দেখছি গাবগাছের পাতার মতো!
পিচঢালা পথ ছেড়ে গাড়ি ঢুকে পড়ে মেঠো পথে। থামে গিয়ে একেবারে বটবৃক্ষের নিচে। আনন্দে মন নেচে ওঠে। একি আসলেই বটবৃক্ষ, নাকি ভিন্ন কিছু! নানান জায়গায় ঘুরতে গিয়ে জীবনে অনেক বটগাছের ছায়ায় বসার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ রকম তো কোনো বটগাছ চোখে পড়েনি! আশ্চর্য সুন্দর সাইট্টা বটগাছের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে নিজেকে বেশ সুখী মনে হলো।
গাছের ওপর থেকে বটের ঝুরি ঝুলে মাটির সঙ্গে মিশেছে। গাছের আদ্যোপান্ত জানতে এবার স্থানীয়দের খোঁজে নামি। দু-একজনের সঙ্গে ভাব জমাই। কিন্তু তথ্যসূত্র নির্ভরযোগ্য মনে হয় না। এদিকে পেটেও টান পড়েছে। গাড়িতে হাঁড়ি-পাতিল ছিল। করিতকর্মা ফারুক বাইকে চড়ে স্থানীয় বাজার থেকে চাল-ডাল-ডিম কিনে আনে। গ্রাম্য চা-দোকানি সন্তোষের সহযোগিতায় শুরু হয় রান্না। সেসব ফেলে আমরা বের হয়ে পড়ি গ্রাম দেখতে।
বিঘার পর বিঘা জমিতে লেবুর বাগান। থোকায় থোকায় ধরে আছে নানান জাতের লেবু। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে হাঁটুজলের ছোট নদী। আর সেই নদীতে জেলে ধরছে মাছ। গাছের ডালে ডালে নানান রঙের পাখি। জনমানবের কোলাহল নেই। পাখিরা নিশ্চিন্ত মনে গেয়ে যায় গান। যেন সাইট্টা গ্রামটি ওদের জন্য অভয়াশ্রম।
ভর সন্ধ্যায় রান্না শেষ। মাগরিব নামাজের পর জোটে ওঠা খিচুড়ি আর ডিম ভুনা। খেতে খেতেই পরিচয় হয় জনি দাস নামের এক তরুণের সঙ্গে।
তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেল বেশ কিছু তথ্য। সাইট্টা গ্রামটি ধামরাই উপজেলার যাদবপুর ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। ষাটটি পরিবার নিয়ে প্রথম
এই গ্রামে বসতি শুরু। সেই থেকে গ্রামের নাম সাইট্টা হয়েছে। গ্রামে মানুষের সংখ্যা প্রায় চার শ। হিন্দু সম্প্রদায়-অধ্যুষিত এই গ্রামের শিক্ষার হার প্রায় ৯৫ শতাংশ। পেশায় অধিকাংশই সরকারি ও বেসরকারি চাকুরে। গ্রামবাসী বন্ধুবৎসল।
জনি বটগাছটি সম্পর্কে জানালেন, এটির বয়স আনুমানিক পাঁচ শ বছর। যদিও সুনির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারে না এর বয়স। তবে বেশির ভাগ মানুষের ধারণা, ‘কম করে চার শ বছর তো হবেই’! বটগাছটি প্রায় দুই একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। একে ঘিরে লোকমুখে চালু আছে অনেক অদ্ভুতুড়ে গল্প। ফলে এর ডালপালা-ঝুরি কোনো দিন ছাঁটা হয়নি। তাই
এর আকার হয়েছে আক্ষরিক অর্থে জায়ান্ট, মহিরুহ। গাছটির পাশেই একটি নাটমন্দির রয়েছে। সেখানে নিয়মিত পূজা-অর্চনা চলে। নির্ভরযোগ্য তথ্য দিয়ে ভদ্রলোক বিদায় নিলেন। নীরব আর নিস্তব্ধ গ্রাম্য পরিবেশে শুরু হলো দ্বিতীয় পর্ব, বারবিকিউ।
কয়লার আগুনে গোশত ঝলসানোর সুযোগে আমাদের কেউ কেউ কুয়াশায় ডোবা ঘুটঘুটে অন্ধকারে বটগাছের তলা ঘুরে এসে অনুভূতি জানাল। রাত নয়টায় সব আয়োজনের ইতি টেনে, শিয়াল পণ্ডিতদের ভাষণ শুনে আমরা ফেরার পথ ধরলাম।
যাবেন যেভাবে
ঢাকার যেকোনো প্রান্ত থেকে নিজ নিজ সুবিধা অনুযায়ী গাবতলী ও উত্তরার থার্ড ফেস এবং আবদুল্লাহপুর হয়ে ধামরাই উপজেলার ধানতারা বা কালামপুর বাজার হয়ে সাইট্টা গ্রামে যাওয়া যাবে। নিজস্ব বা ভাড়ার গাড়িতে গেলেই সুবিধা বেশি। তবে গুলিস্তান থেকে ধামরাই রুটের বাসে ঢুলিভিটা বাসস্ট্যান্ড বা কালামপুর বাজারে নেমে সেখান থেকে অটো কিংবা ভ্যানে চেপে সাইট্টা গ্রামে যাওয়া যায়।